৫ আগস্টের পর হঠাৎ নিজেদের বিএনপি পন্থী পরিচয় দিয়ে রবিউল-শিশির চক্রটি মার্কেটের আহ্বায়ক কমিটি গঠনেও নেয় প্রতারণার আশ্রয়। আজিজ কো অপারেটিভ সুপার মার্কেটের দোকান মালিকদের স্বাক্ষর জাল করে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ভাগিয়ে নেয় নতুন কমিটি। নতুন কমিটির আহবায়ক রবিউল ইসলাম ও সদস্য সচিব ছানাউল্লাহ শিশির। নতুন আহবায়ক কমিটির পদ ভাগিয়ে দোকান দখলের মিশনে নামেন তারা। এছাড়া যেসব দোকান মালিক ৫ আগস্টের পর পলাতক রয়েছেন তাদের চিঠি পাঠিয়ে দোকান দখলের ফাঁদ পাতেন চক্রটি। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা ইলেকশন চাই কিনা এই মর্মে তারা স্বাক্ষর গ্রহণ করেছে। এই স্বাক্ষর সমাজসেবা অফিসে দেখিয়ে তাদের বোঝানো হয়েছে আমরা একটা মিটিং করেছি সেই মিটিংয়ে সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আমাদের কমিটি সমাজসেবার অনুমতি নিল। এটা করে সমাজসেবা অধিদপ্তরকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এদিকে মার্কেট কমিটির গঠনতন্ত্রে নেতৃত্বে আসতে হলে দোকান মালিক হওয়ার কথা থাকলেও রবিউল ইসলাম ও ছানাউল্লাহ শিশির কারোরই নিজস্ব মালিকানার কোন দোকান নেই। শুধু তাই নয়, পুরনো সকল সদস্যকে বাদ দিয়ে নিজেরা স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় বসতে নতুন সদস্য তালিকা গঠনের কাজ শুরু করেন তারা।  

আজিজ সুপার মার্কেটের দোকান মালিক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট শাহ্ ইফতেকার হোসেনের কাছ থেকে তিনি আজিজ সুপার মার্কেটের নীচ তলায় অবস্থিত ৫৫-৫৬ নং দোকানের পজিশন কেনেন। এরপর থেকে দোকান ২টি মো. আজিজুল ইসলামকে বুঝিয়ে দিতে বলা হলেও তা এখনো বুঝিয়ে দেননি রবিউল ইসলাম। 

রবিউলের তালবাহানায় গত ২৩/০৯/২০২৩ইং তারিখে মার্কেট সমিতি বরাবর আবেদন করেন দোকান মালিক আজিজুল ইসলাম। এরপর ১৫ দিনের মধ্যে দোকান খালি করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন রবিউল ইসলাম। কিন্তু দোকান খালি না করে ০৭/১১/২০২৩ইং তারিখে উল্টো জি.ডি. করেন রবিউল। দোকান বুঝে না পাওয়ায় গত ২৬/১১/২০২৩ইং তারিখে আবারও শাহবাগ থানায় জি.ডি (নং-১৯৪০) করেন তিনি। 

এরপর রবিউল ইসলাম দোকান বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে সময় ক্ষেপন করে এবং পূর্বের মালিক শাহ্ ইফতেখার হোসেন রানার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা (নং-৫১০/২০২৩) দায়ের করেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করার জন্য পি.বি.আই তে পাঠায়। পি.বি.আই এর তদন্ত রিপোর্টের পর  আদালত মামলাটি ১১/০৭/২০২৪ইং তারিখে খারিজ করে দেয়।    

আজিজ কো অপারেটিভ সুপার মার্কেটের দোকান মালিকদের স্বাক্ষর জাল করে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নতুন কমিটি ভাগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে- জবাবে কমিটির আহবায়ক রবিউল ইসলাম বলেন, জালিয়াতি করে কি সরকারি অফিস থেকে কামিটির অর্ডার আনা যায়। নতুন কমিটির ঐ অর্ডারটা আমরা নিজেরা করি নাই। আমাদের মার্কেট সমাজসেবা অধিদফতর থেকে নিবন্ধিত, যা সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের আন্ডারে। ৫ আগস্টের পরে যখন আমরা সমাজ সেবা অফিসে যোগাযোগ করে তাদেরকে জানিয়েছি বিগত ১৬ বছর ফেসিস্টরা যেভাবে মার্কেট চালিয়েছে এভাবে আর মার্কেট চলতে দেয়া যায় না। মার্কেটের ফান্ডে কোন টাকা নেই। বিদ্যুৎ বিলের হিসাব নেই। আয়-ব্যয়ের হিসাব নেই। কোন এজিএম নেই। বাৎসরিক মিটিং নেই। তখন সমাজসেবা অধিদফতর থেকে আমাদের বলা হয় আপনারা ব্যবসায়ীদের অনুমোদন (ম্যান্ডেট) নিয়ে আসেন। যে ব্যবসায়ীরা নিবার্চন চায়। 

রবিউল ইসলাম বলেন, এরপর আমরা ব্যবসায়ীদের কাছে যাই এবং তারা নিরভিগ্নে কাগজে স্বাক্ষর করে। সেই স্বাক্ষর সমাজসেবায় জমা দেওয়ার পর তারা আমাদেরকে বৈধভাবে একটি আহবায়ক কামিটি দেয়। ১৬ তারিখ আমরা কমিটির দায়িত্ব বুঝে পেয়েছি। ১৭ তারিখে বিগত-ফেসিস্ট আমলের সভাপতি নাজমুল হাসান নাজু এবং একই কামিটির সহ-সভাপতি আজিজুল ইসলাম আলি’র যোগসাজশে আমাদের এই কামিটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করা হয়। সেই মামলা চলমান। মামলার কারনে আমরা ব্যবসায়ীদের নির্বাচিত কমিটি আওতায় আনতে পারছি না। 

আজিজ কো অপারেটিভ সুপার মার্কেটের দোকান মালিক না হয়েও আপনি কিভাবে নতুন কমিটির আহবায়ক হলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রবিউল ইসলাম বলেন, আমার বাসা ঢাকার নবাবগঞ্জে। প্রথমত আমি এই মার্কেটের ২২ বছরের পুরাতন ব্যবসায়ী। আমার (৫৫-৫৬ নং) দোকানের মালিক শাহ-মোয়াজ্জেম। শাহ-মোয়াজ্জেমের কাছ থেকে আমার দোকান দুটি ভাড়া নেওয়া। এক পর্যায়ে শাহ-মোয়াজ্জেমের সাথে চুক্তি হয় দোকান দুটি আমার কাছে বিক্রি করে দিবেন ৩৭ লাখ টাকায়। এর ভিত্তিতে আমি তাকে ৩৫ লাখ টাকা প্রধান করেছি। ২ লাখ টাকা বাকি ছিল। উনার ছেলে ছিল বিদেশে, উনার ছেলের নামে দোকানটা। শাহ-মোয়াজ্জেমের ছেলে শাহ- ইফতেখার হোসেন রানা বিদেশ থেকে আসার পর আমাকে দোকান রেজিস্ট্রি দেওয়ার কথা। এরপর থেকে আমি প্রতিনিয়ত দোকান ভাড়া পরিশোধ করে আসছি। 

তিনি বলেন, এরইমধ্যে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান শাহ-মোয়াজ্জেম। দোকান বুঝে না পাওয়ায় পূর্বের মালিক শাহ্ ইফতেখার হোসেন রানার বিরুদ্ধে একটি মামলা (নং-৫১০/২৩) দায়ের করেন। আদালতে মামলাটি চলমান। ২০২৫ সালের মার্চে শাহ-মোয়াজ্জেমের ছেলে আমেরিকা প্রবাসী শাহ-ইফতেখার হোসেন রানা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আগে ভাড়াটিয়া মালিকদের নির্বাচন করা এবং ভোট দেওয়ার অধিকার থাকলেও ২০১৮ সালে তারা একটি নকল এজিএম করে। সেখানে আমাদের উপস্থিতি দেখিয়ে তারা পূর্বের গঠনতন্ত্র তাদের মত করে সংশোধন করেছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভাড়াটিয়া দোকান মালিকরা নির্বাচন করতে পারবে না। এটা মূলত আজিজ কো অপারেটিভ সুপার মার্কেট দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি। যেখানে দোকান মালিক (যে নিজে ব্যবসা করে) সে ভোট দিবে। এছাড়া ব্যবসায়ী যাদের ১ বছরের ট্রেড লাইসেন্স আছে তারা ভোট দিতে পারবে এবং সদস্য হতে পারবে।

সমাজসেবা অফিসার কে এম শহীদুজ্জামান বলেন, আহবায়ক কমিটির মেয়াদ চলে গেছে বলেই আমাদের তত্ত্বাবধায়ক কমিটি দিয়েছে। এটা একটা দুষ্ট চক্রের মত।

এদিকে গত জানুয়ারিতে আহবায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার জন্য ঢাকা জেলা সমাজসেবা সহকারি পরিচালক সালমা বেগমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় গত ৩ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য আহবায়ক কমিটিকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। কিন্তু সেই নির্শেনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন রবিউল ও শিশির কমিটি। বেশীরবাগ দোকান মালিকই চায় রবিউল-শিশির চক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নিক সরকারের সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষ। এ সময় তাদের অবৈধ দখল থেকে আজিজ মার্কেটকে উদ্ধার করে যোগ্য নির্বাচন দেয়ার দাবিও জানান ব্যবসায়ীরা।