ইরানে আগেও সরকার হটিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফলাফল কী?
প্রকাশ : ২০-০৬-২০২৫ ১০:৫৫

ছবি : সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানে ইরানের শীর্ষ সামরিক ও পরমাণু নেতাদের টার্গেট করে একাধিক হামলার মধ্য দিয়ে আবারো আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। শুরু থেকেই ইসরায়েল ইঙ্গিত দিয়ে আসছে, এই সংঘাতের লক্ষ্য কেবল প্রতিরক্ষা নয়— বরং ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করা। এর অর্থ হলো, তারা চায় ইরানে সরকারের পতন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি জানিয়েছে, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যা করলেই এই সংঘাত থেমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিকবার খামেনিকে উৎখাতের পক্ষে মত দিলেও, সরাসরি হত্যার ব্যাপারে এখনো মুখ খুলেননি।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?
ইরানিরা ঠিকই জানেন বাইরের হস্তক্ষেপে সরকার পরিবর্তনের অর্থ কী। কারণ, ১৯৫৩ সালেই তারা একবার সেই অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন, যার মূল্য ইরানকে দীর্ঘমেয়াদে দিতে হয়েছিল চড়া হারে।
পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের জয়?
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ পরিকল্পনায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে উৎখাত করা হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা-সমর্থিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে ক্ষমতায় বসানো হয়।
মোসাদ্দেগ ছিলেন তৎকালীন ইরানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দেশের তেলসম্পদ জাতীয়করণের— যা ছিল ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর আঘাত।
ইরানের তেল সম্পদ তৎকালীন ব্রিটিশ কোম্পানি ‘অ্যাঙ্গলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি’র (পরবর্তীতে বিপি) নিয়ন্ত্রণে ছিল। মোসাদ্দেগ এই নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। ইরানিদের কাছে এটি ছিল জাতীয় মর্যাদার বিষয়।
এই পদক্ষেপকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে। তারা আশঙ্কা করে— ইরান যদি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে পুরো মধ্যপ্রাচ্য পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
মার্কিন সিআইএ ও ব্রিটিশ এসআইএস যৌথভাবে ‘অপারেশন আজাক্স’ নামে একটি পরিকল্পনা নেয়। তারা ইরানের ভেতরে মোসাদ্দেগবিরোধী প্রচারণা চালায় এবং জনমত গঠনে মিডিয়া, ধর্মীয় গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে ব্যবহার করে।
পেইড বিক্ষোভ ও দাঙ্গা সংঘটিত হয় রাজধানী তেহরানে। শাহপন্থী বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীও এই দাঙ্গায় অংশ নেয়।
অভ্যুত্থানের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল ফজলুল্লাহ জাহেদির সরকারকে স্থিতিশীল করতে সিআইএ গোপনে ৫০ লাখ ডলার সহায়তা দেয়।
সিআইএ–এর তৎকালীন অপারেশনাল হেড ছিলেন কারমিট রুজভেল্ট জুনিয়র, যিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের নাতি।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। ২০১৩ সালে সিআইএ গোপন নথি প্রকাশ করে, যাতে তাদের ভূমিকার পূর্ণ বিবরণ উঠে আসে।
কী পেল যুক্তরাষ্ট্র, কী হারাল ইরান?
যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত শাহ পাহলবি একটি স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করে এবং পশ্চিমা আদর্শে আধুনিকায়নের নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্র হয়ে ওঠেন।
বাইরের হস্তক্ষেপে সরকার পতনের বিষয়টি ইরানিদের মনে গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই ক্ষোভ পরবর্তী কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবকে জোরদার করে।
১৯৭০-এর দশকে ব্যাপক দুর্নীতি, দমন-পীড়ন ও পশ্চিমাপন্থী নীতির প্রতিবাদে লাখ লাখ ইরানি রাস্তায় নেমে আসেন। ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামপন্থি উভয় পক্ষই শাহবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে এক রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শাহ পতিত হন। ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে ওঠে—যার নেতৃত্বে আসেন আয়াতুল্লাহ খোমেনি।
আবার কি সেই পথে হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্র?
বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যা করলেই যুদ্ধ থামবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এদিকে ইরান বলছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে তাদের ঘাঁটি ও মিত্রদের ওপর পাল্টা হামলা চালানো হবে। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, তেহরানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে, প্রথমেই ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা হবে। এরপর অন্যান্য আরব দেশের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে পাল্টা জবাব দেবে ইরান।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প এই যুদ্ধে জড়ালে তা ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
ইউরোপীয় কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো এলি গেরানমায়েহ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলছেন, হয় তাকে কূটনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নিতে হবে, নয়ত যুদ্ধে জড়াতে হবে। এই ধরনের মুহূর্তে নেতাদের সবসময়ই একটি বিকল্প থাকে। ট্রাম্প এর আগেও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে সরে এসেছেন। চাইলে আবারো তিনি একই পথে হাঁটতে পারেন।
গেরানমায়েহ মনে করেন, ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার সিদ্ধান্ত নিলে তেহরান সেটাকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করবে। আর একবার এই প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেলে কী ঘটবে, তা কিন্তু কেউ জানে না। এই সংঘাত ট্রাম্পের পুরো মেয়াদকেই গ্রাস করে ফেরতে পারে।
গেরানমায়েহ বলেন, ইরানের জন্য আত্মসমর্পণ কোনো বিকল্প নয়। ইরান জানে, তারা সামরিকভাবে জয়ী হতে পারবে না। কিন্তু তারা এটা নিশ্চিত করতে চায়, এই যুদ্ধে কেউ যেন বিজয়ী হতে না পারে।
তার মতো ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ‘ইরান প্রজেক্টের’ পরিচালক আলি ভায়েজও মনে করেন, খামেনিকে আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা সফল হবে না।
সিএনএনকে তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের আগ্রাসনে ভর করে ইরানের নেতৃত্বকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার চেষ্টা করবেন, ততক্ষণ তা সফল হবে না।
ট্রাম্প যুদ্ধে জড়ালে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও তাদের মিত্ররা নতুন বৈরিতার মুখে পড়বে বলে মনে করেন মার্কিন সেনেটর ক্রিস মারফি। সিএনএনকে তিনি বলেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে উৎসাহ দিচ্ছেন, তারা হয়ত ইরাক যুদ্ধ ও আফগানিস্তান যুদ্ধের বিপর্যয়ের কথা ভুলে গেছেন।
কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যের এ ডেমোক্র্যাট সিনেটর বলছেন, ওই দুই যুদ্ধের পরিণতি হিসেবে হাজার হাজার মার্কিন নাগরিকের প্রাণ যায়। ওই অঞ্চলে নতুন করে বিদ্রোহের মুখে পড়ে মার্কিন স্বার্থ ও তাদের মিত্ররা।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com