এমআই সিক্সের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান হচ্ছেন ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি
প্রকাশ : ১৬-০৬-২০২৫ ১৬:২৫

ছবি : সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
যুক্তরাজ্যের প্রধান বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা, সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এমআই সিক্স, তার ১১৬ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক নারী কর্মকর্তাকে সংস্থাটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে। ৪৭ বছর বয়সী ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি এমআই সিক্সের ১৮তম প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন চলতি বছরের শেষ দিকে। তিনি বর্তমান প্রধান রিচার্ড মুরের স্থলাভিষিক্ত হবেন।
মেট্রেওয়েলি বর্তমানে সংস্থাটির প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন (Innovation and Technology) বিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। এই পদে তার পরিচিতি ‘কিউ’ নামে, যা জেমস বন্ড চলচ্চিত্র সিরিজে গ্যাজেট ও প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত চরিত্রটির নাম থেকেও অনুপ্রাণিত। ‘কিউ’-এর দায়িত্ব হলো গোপন এজেন্টদের পরিচয় সুরক্ষা, আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি যেমন চীনের বায়োমেট্রিক ট্র্যাকিংয়ের মতো হুমকি মোকাবেলায় কৌশল তৈরি এবং এমআই সিক্সের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো।
সংস্থার প্রধান পদটি পরিচিত ‘সি’ নামে- একটি ঐতিহাসিক সাংকেতিক নাম, যার সূচনা হয়েছিল ১৯০৯ সালে গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম প্রধান ক্যাপ্টেন ম্যানসফিল্ড কামিংয়ের হাত ধরে। তিনি সব চিঠি ‘সি’ দিয়ে স্বাক্ষর করতেন এবং সবুজ কালি ব্যবহার করতেন, যা আজও এমআই সিক্স প্রধানদের একটি ঐতিহ্য হিসেবে বহাল আছে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে পড়াশোনা করা মেট্রেওয়েলি ১৯৯৯ সালে সিক্রেট সার্ভিসে যোগ দেন। এর আগে তিনি এমআই ফাইভে (যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা) পরিচালক পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশনে কাজ করেছেন।
২০২১ সালে টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি এখন বহুমাত্রিক ও জটিল। শত্রু রাষ্ট্র, গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা, অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি, এবং সংবেদনশীল প্রযুক্তি চুরি- সব মিলিয়ে আমাদের সুরক্ষার পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। সেই সময় এমআই ফাইভের ‘ডিরেক্টর কে’ হিসেবে তার বক্তব্যে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড এবং চীনের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাবকে বড় হুমকি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
২০২৪ সালে রাজার জন্মদিন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হন মেট্রেওয়েলি। তাকে দেওয়া হয় ‘অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জ (সিএমজি)’ উপাধি; যা সাধারণত কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় বিশেষ অবদানের জন্য দেওয়া হয়।
যুক্তরাজ্যের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি মেট্রেওয়েলিকে ‘আদর্শ প্রার্থী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, বৈশ্বিক অস্থিরতা ও উদীয়মান নিরাপত্তা হুমকির প্রেক্ষাপটে এই নিয়োগ সময়োপযোগী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ব্লেইজ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য দৃঢ় নেতৃত্ব দেবেন এবং বহিঃবিশ্বে যুক্তরাজ্যের স্বার্থ সুরক্ষায় অসামান্য ভূমিকা রাখবেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও এই নিয়োগকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, বর্তমানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিদায়ী প্রধান রিচার্ড মুর এই নিয়োগে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ব্লেইজ একজন দক্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও দূরদর্শী নেতা। প্রযুক্তিনির্ভর গোয়েন্দা ব্যবস্থাপনায় তিনি সংস্থাটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেট্রেওয়েলি এমন সময় এমআই সিক্সের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, যখন সংস্থাটি বহু নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়া- এই চারটি রাষ্ট্রকে বর্তমানে যুক্তরাজ্যের জন্য প্রধান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চারটি দেশই পশ্চিমা স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে চ্যালেঞ্জ কেবল ভূ-রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও এমআই সিক্সকে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে হচ্ছে। সাইবার যুদ্ধ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বায়োমেট্রিক ট্র্যাকিং এবং বড় তথ্য বিশ্লেষণের যুগে এজেন্ট-ভিত্তিক ‘ক্লাসিক স্পাইং’ পদ্ধতি অনেকাংশেই রূপান্তরিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী এই প্রযুক্তিগত রূপান্তরের বাস্তবতায় এমআই সিক্স এখন শত্রু রাষ্ট্র ও সংগঠনগুলোর ডিজিটাল কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় নিজের সক্ষমতা ঝালিয়ে নিচ্ছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখাই এখন সংস্থাটির প্রধান লক্ষ্য। গত সেপ্টেম্বরে বিদায়ী প্রধান রিচার্ড মুর ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নস একটি যৌথ প্রবন্ধে সতর্ক করে বলেন, শীতল যুদ্ধের পর বিশ্ব এখন সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকির মুখে।
তারা ইউক্রেন যুদ্ধ, ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার গুপ্তচরবৃত্তি এবং চীনের গোয়েন্দা বিস্তারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাদের মতে, ২১শ শতাব্দীর প্রধান ভূরাজনৈতিক ও গোয়েন্দা চ্যালেঞ্জ হিসেবে চীনের উত্থানকে দেখতে হবে। তারা মধ্যপ্রাচ্যেও উত্তেজনা প্রশমনে সক্রিয় কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখার পক্ষে মত দেন। এই প্রেক্ষাপটেই ব্লেইজ মেট্রেওয়েলির নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
এমআই সিক্সের প্রধান হিসেবে তিনি শুধু সংস্থার অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বই দেবেন না, বরং আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের ভূমিকাও পালন করবেন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, রাষ্ট্রীয় হুমকি প্রতিরোধ এবং যুক্তরাজ্যের বৈশ্বিক স্বার্থ রক্ষায় তার কৌশলী নেতৃত্ব কতটা কার্যকর হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com