গণপিটুনিতে আগস্টের ১০ দিনে নিহত নয়জন
প্রকাশ : ১২-০৮-২০২৫ ১১:২৪

প্রতীকী ছবি
নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশজুড়ে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। চলতি আগস্টের প্রথম দশ দিনেই অন্তত ১৩টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে— যার মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন নয়জন, আহত হয়েছেন আরো ১৩ জন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, এ ধারাবাহিক সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং বিচারহীনতার দীর্ঘস্থায়ী সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এটি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএফএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ৭৮ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। আগস্টের প্রথম দশ দিনের নয়জন নিহতকে যুক্ত করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৭। একই সময়ে আহত হয়েছেন ২৬৬ জন মানুষ। অপর এক মানবাধিকার সংস্থা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত কমপক্ষে ১১১ জন মানুষ ‘মব সন্ত্রাস’-এর শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
এ সহিংসতার সর্বশেষ বড় ঘটনা ঘটেছে ৯ আগস্ট, রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায়। চুরি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় দুইজনকে— রূপলাল দাস এবং তার শ্বশুর প্রদীপ দাসকে। স্বজনদের বর্ণনায় উঠে এসেছে, সেদিন বাড়ি ফেরার পথে ভ্যানচোর সন্দেহে স্থানীয় জনতা তাঁদের ঘিরে ধরে। প্রদীপ দাস নিজেই ভ্যানগাড়ি চালাচ্ছিলেন, পাশে ছিলেন জামাই রূপলাল। জনতার মারধরের আগে প্রদীপ হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চান, রূপলাল নিজের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু জনতার ক্ষোভ থামেনি, শেষ পর্যন্ত দুজনই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।
নিহত রূপলালের মা, বৃদ্ধ লালিচা দাস, শোকে ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে কোনো অপরাধী ছিল না। পেশায় ছিল মুচি— জুতা সেলাই করে সংসার চালাত। মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করতে ভাগনি জামাইকে বাড়ি নিয়ে আসছিল রূপলাল।
এ ঘটনা শুধু একটি উদাহরণ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগস্টের প্রথম ১০ দিনের ১৩টি গণপিটুনির মধ্যে আটটিই চুরি সন্দেহে ঘটেছে। বাকি পাঁচটির মধ্যে কোনোটি চাঁদাবাজি, কোনোটি ব্যক্তিগত শত্রুতা, আবার কোনোটি স্থানীয় বিরোধ থেকে ঘটেছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে দেশে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়ে যায়, যা জনমনে ভয় এবং ক্ষোভ সৃষ্টি করে। কিন্তু বিচারহীনতার দীর্ঘস্থায়ী প্রবণতা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারের দৃশ্যমান ব্যর্থতা মিলে জনতার হাতে তাৎক্ষণিক শাস্তির সংস্কৃতি আরও বিস্তার লাভ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করলে মানুষও সহিংস হয়ে ওঠে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তাৎক্ষণিক মব সহিংসতা ও সংগঠিত মব হামলা— দুটিই বেড়েছে। তার মতে, সংগঠিত মব হামলার পেছনে অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপ ‘পালস সার্ভে ৩’-এ দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ৫৬ শতাংশ, রাতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ৬১ শতাংশ এবং পোশাকের কারণে রাস্তায় হয়রানির আশঙ্কা জানিয়েছেন ৬৭ শতাংশ মানুষ।
সরকারও মব সহিংসতা নিয়ে অস্বস্তি বোধ করছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, মব সন্ত্রাস দমন কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ পুলিশের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে। তার মতে, যে পুলিশ জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের বিরোধী ছিল, তারা যখন দেখে অভ্যুত্থানপন্থি কিছু গোষ্ঠী মব গঠন করছে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই সেটি দমন করতে পারেনি।
গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন মনে করেন, সরকারের পদক্ষেপ এখনো দুর্বল ও বিভ্রান্তিকর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা জনগণের আস্থা অর্জনের মতো নয়। তার মতে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন মব সহিংসতার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে আদালত পর্যন্ত মবের প্রতি এক ধরনের ভীতি কাজ করছে, যা পুলিশের কার্যকর ভূমিকা পালনে বাধা সৃষ্টি করছে। নূর খান লিটনের মতে, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের জরুরি ভিত্তিতে শক্ত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এক মাসেরও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া এসব মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গণপিটুনি কেবল আইনের শাসনের ব্যর্থতা নয়— এটি সমাজের নৈতিক অবক্ষয়েরও প্রতিফলন। যদি দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তাহলে এমন সহিংসতা আরো বিস্তৃত হয়ে পড়তে পারে, যা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com