জাকসুতেও ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয়
প্রকাশ : ১৩-০৯-২০২৫ ২৩:৪৯

ছবি : সংগৃহীত
জাবি প্রতিনিধি
তেত্রিশ বছর পর অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু ভিপি এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাজহারুল ইসলাম জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে জিএস ও দুই এজিএস পদসহ মোট ২৫ পদের মধ্যে ২০টিতে বিজয়ী হয়েছেন ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেলের প্রার্থীরা।
শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ভোট গ্রহণের দুইদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান।
ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, আব্দুর রশিদ জিতু তিন হাজার ৩৩৪ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী ছাত্রশিবিরের আরিফুল্লাহ আদিব দুই হাজার ৩৮৯ ভোট পেয়েছেন।
অপরদিকে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক পদে মাজহারুল ইসলাম তিন হাজার ৯৩০ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাগছাসের প্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম পেয়েছেন এক হাজার ২৩৮ ভোট।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের (এজিএস) দুটি পদেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রার্থী ফেরদৌস আল হাসান দুই হাজার ৩৫৮ ভোট এবং আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা তিন হাজার ৪০২ জয় পেয়েছেন।
১৯টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ১৫টি জিতেছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল। বাকি চারটি পদের মধ্যে ভিপিসহ তিনটি পদে স্বতন্ত্র এবং একটিতে বাগছাস প্রার্থী জয় পেয়েছেন। কার্যকরী সদস্যের ছয় পদের পাঁচটি জিতেছেন শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা, একটিতে বাগছাসের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
অন্যান্য পদে জয় পেয়েছেন: শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক- আবু ওবায়দা ওসামা (শিবির প্যানেল), পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক- মো. শাফায়েত মীর (শিবির প্যানেল), সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক- মো. জাহিদুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), সাংস্কৃতিক সম্পাদক- মহিবুল্লাহ শেখ জিসান (স্বতন্ত্র), সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক- মো. রায়হান উদ্দীন (শিবির প্যানেল), নাট্য সম্পাদক- মো. রুহুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), ক্রীড়া সম্পাদক- মাহমুদুল হাসান কিরণ (স্বতন্ত্র), সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (নারী)- ফারহানা আক্তার লুবনা (শিবির প্যানেল), সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (পুরুষ)- মো. মাহাদী হাসান (শিবির প্যানেল), তথ্যপ্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক- মো. রাশেদুল ইসলাম লিখন (শিবির প্যানেল), সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক- আহসাব লাবিব (গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-বাগছাস), সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (নারী)- নিগার সুলতানা (শিবির প্যানেল), সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (পুরুষ)- মো. তৌহিদ হাসান (শিবির প্যানেল), স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সম্পাদক- হুসনী মোবারক (শিবির প্যানেল) এবং পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক- মো. তানভীর রহমান (শিবির প্যানেল)।
কার্যকরী সদস্য হয়েছেন- মো. তরিকুল ইসলাম (পুরুষ, শিবির প্যানেল), মো. আবু তালহা (পুরুষ, শিবির প্যানেল), মোহাম্মদ আলী চিশতি (পুরুষ, বাগছাস), নাবিলা বিনতে হারুণ (নারী, শিবির প্যানেল), ফাবলিহা জাহান (নারী, শিবির প্যানেল) ও নুসরাত জাহান ইমা (নারী, শিবির প্যানেল)।
হল সংসদে যারা জয়ী: ২১টি হল সংসদেও মধ্যে- ১৩ নং (ছাত্রী) হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন নাহাদাতুন হাসানা, জিএস নির্বাচিত হয়েছেন মোহসিনা তুবা ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন সাদিয়া মেহজাবিন। বেগম খালেদা জিয়া হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন ফারহানা রহমান, জিএস হয়েছেন ফাতেমা তুজ–জোহরা ও এজিএস রায়হানা সরকার। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন অমিত কুমার বণিক, জিএস নির্বাচিত হয়েছেন মাহমুদুল হাসান ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন মির্জা আদনান ইসলাম (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা)। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন সিফাত উল্লাহ, জিএস হয়েছেন মাহমুদুল হাসান ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন তারিক আহমেদ। ফজিলতুন্নেসা হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন ঐশী সরকার (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা), জিএস নির্বাচিত হয়েছেন ফারজানা তাবাসসুম ও এজিএস প্রমা রাহা। শহীদ রফিক-জব্বার হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন মেহেদি হাসান, জিএস হয়েছেন শরিফুল ইসলাম ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন আরিফুল ইসলাম। ২১ নম্বর (ছাত্র) হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন ইবনে শিহাব, জিএস হয়েছেন ওলিউল্লাহ মাহাদী ও এজিএস হয়েছেন তুষার আহমেদ। কাজী নজরুল ইসলাম হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন রাকিবুল ইসলাম, জিএস নির্বাচিত হয়েছেন আলী আহমেদ ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন সামিন ইয়াসির। আ ফ ম কামাল উদ্দিন হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন জিএমএম রায়হান কবীর, জিএস নির্বাচিত হয়েছেন আবরার শাহরিয়ার ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন রিপন মন্ডল (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা)। মীর মশাররফ হোসেন হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন খালেদ জুবায়ের, জিএস নির্বাচিত হয়েছেন শাহরিয়ার নাজিম ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন আরাফাত হোসেন। মওলানা ভাসানী হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন আবদুল হাই স্বপন, জিএস নির্বাচিত হয়েছেন হৃদয় পোদ্দার ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন রাকিব হাসান। শহীদ সালাম-বরকত সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন মারুফ হোসেন, জিএস হয়েছেন মাসুদ রানা ও এজিএস আবরার আজিম ভুঁইয়া। আলবেরুনী হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন রিফাত আহমেদ শাকিল, জিএস হয়েছেন মুনতাসির বিল্লাহ খান ও এজিএস সাদমান হাসান খান। নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন বুবলী আহমেদ (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা), জিএস হয়েছে সুমাইয়া খানম (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা)। এই হলে এজিএস প্রার্থী নেই। ১০ নম্বর (ছাত্র) হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন আসিফ মিয়া, জিএস নির্বাচিত হয়েছেন মেহেদী হাসান ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন নাদিম মাহমুদ। ১৫ নম্বর (ছাত্রী) হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন শারমীন খাতুন (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা), জিএস মেহনাজ মোহনা ও এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন শাহানা আক্তার।
জাকসুতে অধিকাংশ পদে জয়ের মধ্য দিয়ে ডাকসুর পর আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নিয়ন্ত্রণ নিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যারা এর আগে কখনো জাকসুতে কোনো পদ পায়নি। ডাকসু নির্বাচনের দুই দিনের মাথায় ঢাকার অদূরে সাভারের এই ক্যাম্পাসের ভোটগ্রহণ নিয়ে সারাদেশের মানুষের আগ্রহ ছিল। জাকসুর ফলাফল ঘোষণার আগে ২১টি হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পাশে নিয়ে এগোতে চাই-নবনির্বাচিত জাকসু ভিপি: জাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি আব্দুর রশিদ জিতু বলেছেন, ‘এই জাহাঙ্গীরনগর আমাকে চেয়েছে বিধায় আজ আমি ভিপি নির্বাচিত হয়েছি। ক্যাম্পাসের প্রতিটি মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, দায়বদ্ধ। আমি বলতে চাই, আমার প্রতিটি কাজ হবে শিক্ষার্থীদের হয়ে, আমি তাদের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পাশে নিয়ে আমি এগিয়ে যেতে চাই।’
ফল ঘোষণার পর জয়ের প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, শুক্রবার যিনি আমাদের থেকে চলে গিয়েছেন (ভোট গুনতে গিয়ে মারা যাওয়া শিক্ষক), আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
যা বললেন জিএস মাজহারুল: শনিবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রশিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট। সংবাদ সম্মেলনের নবনির্বাচিত জিএস মাজহারুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের যে নিরঙ্কুশ বিজয়, এ বিজয় শুধুমাত্র আমাদের নয়, এ বিজয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সকল শিক্ষার্থীর।
তনি আরো বলেন, আমরা মনে করি আমরা বিজয় অর্জন করিনি। আমরা তখনই বিজয় অর্জন করবো, যেদিন আমরা আমাদের জাকসু থেকে দায়িত্ব পালন শেষ করে পরবর্তী জাকসু অনুষ্ঠিত করতে পারবো এবং যেদিন শিক্ষার্থীরা আমাদের স্বীকৃতি দেবে যে আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযতভাবে পালন করতে পেরেছি, এই ক্যাম্পাসের হাজার হাজার শিক্ষার্থী যারা আমোদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, তাদের আমানতের ভার আমরা রক্ষা করতে পেরেছি, সেই দিন আমরা বলতে পারবো আমরা বিজয় অর্জন করতে পেরেছি।
যা বললেন শিবির সভাপতি: ফলাফল ঘোষণার পর শনিবার রাতে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ঢাবির মতো জাবিতেও শিক্ষার্থীরাই বিজয়ী হলেন। যে ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির পরিচয় দেওয়া ছিল হত্যাযোগ্য। এই বিজয় মহান রবের একান্ত অনুগ্রহ। আমরা সারা দেশের কোথাও কোনো আনন্দ মিছিল করব না। শুধু মহান রবের কাছে সিজদার মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করব।
শিবির সভাপতি বলেন, কারো প্রতি আমাদের কোনো অনুযোগ ও বিদ্বেষ নেই। আমরা নিজেদের ও সব ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের ভুলের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই। গর্ব ও অহংকার হোক আমাদের পায়ের ধুলা। উদারতা ও বিনয় হবে আমাদের ব্যবহারের অলংকার।
তিনি আরো বলেন, গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক যাত্রা ও নানা ঐতিহ্যের প্রতীক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হোক সম্প্রীতির অনন্য উপমা। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ হয়ে উঠুক সবার বাংলাদেশ।
প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর এই ক্যাম্পাসে বৃহস্পতিবার দিনভর ভোট শেষে প্রায় ৬৮ শতাংশ ভোট পড়ে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ভোট গণনা শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে। এই দীর্ঘ সময় পর ফলাফলের ঘোষণা এল।
ভোটগ্রহণে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার অভিযোগের পর অধিকাংশ প্যানেলের বর্জন, দীর্ঘ সময় ধরে ভোটগণনার কাজের মধ্যে নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা এক শিক্ষকের মৃত্যুর মতো ঘটনা লেখা থাকবে এ নির্বাচনের আমলনামায়।
তবে মূল বিপত্তি ঘটেছে অভিযোগ থেকে মুখ রক্ষার জন্য ওএমআর মেশিনের বদলে হাতে ভোট গুনতে গিয়ে। জামায়াত সংশ্লিষ্ট এক কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনার অভিযোগ উঠলে নির্বাচন কমিশন ভোট গণনার কাজটি মেশিনের বদলে হাতে করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর তা করতে গিয়েই লেজেগোবরে দশা হয়।
১৯৭২ সালে শুরু হওয়া জাকসু নির্বাচনের এবারের দশম আয়োজন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ ছিল শুরু থেকে। ছাত্র সংগঠনগুলোও ভোটের দাবিতে সোচ্চার ছিল।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন পরিস্থিতিতে কয়েক দফা পেছানোর পর জাকসু নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর। ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাগছাস, বাম-প্রগতিশীল, স্বতন্ত্রদের অন্তত সাতটি প্যানেলসহ অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com