নির্বাচন আয়োজনে শঙ্কা জাগাচ্ছে উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র
প্রকাশ : ১৪-০৮-২০২৫ ১২:৩৫

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তেমনি বেড়ে চলেছে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা। এর মূল কারণ হলো, গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় দুষ্কৃতকারীদের হাতে লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রের একটি বড় অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি।
ওই দিন আন্দোলনকারীদের প্রচণ্ড চাপ ও হামলার মুখে পুলিশ বাহিনী এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সরকার পতনের খবরে দেশজুড়ে থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি কার্যত শূন্য হয়ে পড়ে। এই সুযোগে সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীরা বিভিন্ন থানায় মজুদ থাকা হাজার হাজার সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায়।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই লুট হওয়া এসব অস্ত্র উদ্ধারে দেশজুড়ে ধারাবাহিক অভিযান শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যায়ক্রমে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও এখনো প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র নিখোঁজ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, এই অস্ত্রগুলো এখন অপরাধীদের হাতে রয়েছে, যা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার হতে পারে। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের পরিবেশ গড়ে তুলতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু পুলিশের খোয়া যাওয়া এই অস্ত্রগুলো নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞ ও নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনায় দেশের ৫৭৪টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা ও লুটপাট হয়। এতে খোয়া যায় মোট পাঁচ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র এবং ছয় লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ রাউন্ড গোলাবারুদ। পরবর্তী সময়ে পরিচালিত অভিযানে চার হাজারের বেশি অস্ত্র এবং প্রায় চার লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার হলেও এখনো প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো হদিস মেলেনি।
গত জুলাইয়ে ঢাকা সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত লুট হওয়া অস্ত্রের ৮০ শতাংশ উদ্ধার করেছে। তিনি আশ্বাস দেন, বাকি ২০ শতাংশ অস্ত্রও আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে জব্দ করা হবে, যাতে সেগুলো দিয়ে কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা না যায়।
সেনাবাহিনী ও পুলিশের পাশাপাশি ঢাকায় বিশেষ অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। গত ৯ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনী রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার কয়েকটি দোকান ও গুদামে অভিযান চালিয়ে প্রায় এক হাজার ১০০টি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করে এবং অস্ত্র বিক্রি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত নয় জনকে গ্রেপ্তার করে। ঢাকা মহানগর পুলিশও লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তাদের হিসাবে, জুলাই-আগস্টে ডিএমপির স্থাপনা থেকে প্রায় এক হাজার ৯০০টি অস্ত্র লুট হয়, যার মধ্যে এক হাজার ২০০টির বেশি ইতোমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। ডিএমপির প্রত্যাশা, জাতীয় নির্বাচনের আগে অবশিষ্ট অস্ত্রও উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলমান রয়েছে এবং নির্বাচনের আগে একটি স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইনও একই কথা বলেছেন। তিনি জানান, সারা দেশে বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশের বিশেষ টহল, নজরদারি ও গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। তার মতে, এই অস্ত্রগুলো পরিকল্পিতভাবে লুট করা হয়েছে এবং এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্যই নেওয়া হয়েছে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, শুধুমাত্র পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে অপরাধীরা অস্ত্র ফেরত দেবে না। বরং সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান চালানো হলে কার্যকর ফল পাওয়া সম্ভব। নতুবা এই অস্ত্র ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরা নির্বাচনের সময় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চাপের মধ্যে রাখবে এবং ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য তথ্যদাতাদের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কতগুলো অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা তিনি জানাতে পারেননি, যদিও সাত শতাধিক অস্ত্র এখনও নিখোঁজ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
ফলে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, উদ্ধার না হওয়া এই বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রকে ঘিরে উদ্বেগও ততই বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিযান চালালেও এ অস্ত্রগুলো পুরোপুরি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com