weather ২৮.৯৯ o সে. আদ্রতা ৮৪% , সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাকিস্তানে ট্রেন ছিনতাই : ১৯০ জিম্মি উদ্ধার, ৩০ হামলাকারী নিহত

প্রকাশ : ১৩-০৩-২০২৫ ০০:৩০

ছবি : সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা চারশরও বেশি যাত্রীকে বহন করা একটি ট্রেন ছিনতাইয়ের পর নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১৯০ জন বেসামরিককে উদ্ধার ও ৩০ হামলাকারীকে হত্যা করেছে বলে দেশটির গণমাধ্যম বুধবার (১২ মার্চ) প্রতিবেদনে জানিয়েছে। 

বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে। ট্রেন হাইজ্যাক করার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে বিএলএ। সম্প্রতি প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, কীভাবে তাদের হামলাকারী দল প্রথমে ট্রেনের কাছে একটি বোমা ফেলে এবং পরে যোদ্ধারা ট্রেনের যাত্রীদের জিম্মি করে।

প্রশ্ন আসছে বিএলএ কী? তাদের উদ্দেশ্যই বা কী? বিএলএ হলো পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। বেলুচ লিবারেশন আর্মি নামেও এই গোষ্ঠী পরিচিত। পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকে বেলুচিস্তান প্রদেশকে স্বাধীন করতে চান এই গোষ্ঠীর সদস্যরা। ২০০০ সালের মধ্যভাগে বিএলএর যাত্রা শুরু। প্রদেশটিতে কয়েক বছর ধরে একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছেন বিএলএর সদস্যরা।

পবিত্র রমজান মাসে নিরীহ মানুষের ওপর চালানো এ হামলার তীব্র সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ সহ জাতীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

আয়তনে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ বেলুচিস্তান। তবে প্রদেশটি বেশ অনুন্নত। উন্নয়নের যাত্রায় পাঞ্জাব-সিন্ধুর চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে বেলুচিস্তান। প্রদেশটিতে দেড় কোটি মানুষের বসবাস।

এদিকে রেলওয়ের কর্মকর্তারা ডনকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল প্রায় ৯টার দিকে নয় বগির জাফর এক্সপ্রেস খাইবার পাখতুনখওয়ার পেশোয়ার শহরের উদ্দেশে বেলুচিস্তানের কোয়েটা ছেড়ে যায়। দুপুর প্রায় ১টার দিকে তারা খবর পান বেলুচিস্তানের বোলান জেলার পানির ও পেশি রেল স্টেশনের মাঝামাঝি মুশকাফের নিকটবর্তী রেলওয়ে টানেল ৮-এর কাছে ট্রেনটিতে হামলা হয়েছে।

এক কর্মকর্তা বলেন, সশস্ত্র ব্যক্তিরা ট্রেনের লোকোমোটিভ লক্ষ্য করে রকেট ছোড়ে ও গুলিবর্ষণ করে, এতে ট্রেনটি থেমে যায়।

প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা গেছে, হামলাকারীরা ট্রেনটির বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষীকে হত্যা করে ট্রেনটি ছিনতাই করে। তারপর তারা যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্র পরীক্ষা শুরু করে এবং কিছু যাত্রীকে জিম্মি করে ধরে নিয়ে যায়।

কোয়েটা থেকে পাকিস্তান রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মুহাম্মদ কাশিফ আন্তর্জাতিক এক বার্তা সংস্থাকে বলেছিলেন, ট্রেনটিতে থাকা ৪৫০ জনেরও বেশি যাত্রীকে বন্দুকধারীরা জিম্মি করে রেখেছে। যাত্রীদের মধ্যে নারী ও শিশু আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সশস্ত্র হামলাকারীদের বড় একটি দল, যাদের কাছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও রকেট লঞ্চার আছে তার জিম্মিদের নিয়ে নিকটবর্তী পর্বতে আশ্রয় নিয়েছে। যাওয়ার আগে তারা বিস্ফোরক দিয়ে রেললাইন উড়িয়ে দিয়ে যায়।

জিও নিউজ জানিয়েছে, যে যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু রয়েছেন। বাকি জিম্মিদের উদ্ধারে অভিযান চলমান।

রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাফর এক্সপ্রেসের উদ্ধার পাওয়া যাত্রীদের মধ্যে ৫৭ জনকে গতকাল বুধবার ভোরে কোয়েটায় পাঠানো হয়েছে, আরো ২৩ জন মাখ শহরে রাখা হয়েছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের পর সশস্ত্র হামলাকারীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে নারী ও শিশুদের জিম্মি করে রেখেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

হামলার খবর পাওয়ার পর পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পর্বতময় বন্ধুর ওই এলাকায় অভিযান শুরু করে। বেসামরিকদের উপস্থিতি থাকায় অভিযানটি খুব সতর্কতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে।

আগেও এমন হামলা: ট্রেনে হামলায় দায় স্বীকার করে দেওয়া এক বিবৃতিতে বিএলএ বলেছে, ছয় সামরিক সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। ট্রেন লাইনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এর ফলে ট্রেনটি থেমে গেলে নিয়ন্ত্রণ নেন গোষ্ঠীর সদস্যরা। প্রাদেশিক সরকারের মুখপাত্র শহীদ রিন্দ বলেন, এ ঘটনায় বেলুচিস্তান সরকার জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংগঠিত করা হয়েছে। সিবি ও আশপাশের শহরগুলোর হাসপাতালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। সতর্ক রাখা হয়েছে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। 

এদিকে উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলেও বেলুচিস্তান খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এখানে তামার খনি ও গ্যাসকূপ রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বেলুচদের। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভিযোগ, স্বাধীনতার পক্ষে যারাই সরব হয়েছেন, রাষ্ট্র তাদের অপহরণ করেছে, নির্যাতন করেছে।

প্রায় এক দশক আগে বেলুচিস্তানে শুরু হয় ছয় হাজার ২০০ কোটি ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এর ফলে সেখানকার জটিল সংঘাতময় পরিস্থিতি আরো জোরদার হয়।

বেলুচিস্তানে চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও স্থাপনার ওপর বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছে বিএলএ। এর মধ্যে আলোচিত গোয়াদার বন্দরও রয়েছে। সিপিইসি প্রকল্পের অন্যতম বড় অংশ এই বন্দর। এসব হামলায় অনেক চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন।

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বেলুচিস্তানজুড়ে হামলা-সংঘাতের ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। গত মাসে স্থানীয় কালাত শহরে বিএলএর হামলায় অন্তত ১৮ সেনা নিহত হন। মার্চের শুরুর দিকে একই শহরে বিএলএর এক নারী সদস্য আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য নিহত হন।

জাফর এক্সপ্রেসেও এর আগে বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর বিএলএ সদস্যরা রেললাইন উড়িয়ে দিলে মাস দুয়েক ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। গত নভেম্বরে কোয়েটা রেলস্টেশন ত্যাগের আগমুহূর্তে এই ট্রেনে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিরাপত্তা রক্ষীসহ অন্তত ৩০ জন নিহত হন।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএলএর সদস্যদের কর্মকাণ্ড দমনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা ও পুরোনো কৌশল এই গোষ্ঠীর সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ।

ওয়াশিংটনভিত্তিক বেলুচিস্তান-বিষয়ক বিশ্লেষক মালিক সিরাজ আকবর বলেন, বিএলএ একসময় ছোট আকারের হামলা চালাত। যেমন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে হামলা হতো কিংবা পাইপলাইন ধ্বংস করত। ধীরে ধীরে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা তুলনামূলক বড় আকারের হামলা চালাতে শুরু করেছেন।

এই বিশ্লেষক আল-জাজিরাকে আরো বলেন, ‘এই গোষ্ঠী এখন যাত্রীবাহী ট্রেনে সাম্প্রতিক হামলার মতো বড় হামলা চালিয়েছে। এই পরিবর্তন তাদের ক্রমবর্ধমান সাহসের প্রতিফলন। এখন এটা বোঝা যায় যে এই গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের নেই।’

বেলুচিস্তান-বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ কাকার বলেন, বিএলএ তার কমান্ড কাঠামো শক্তিশালী করেছে। অভিযানের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের আরো বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

রফিউল্লাহ কাকার আল-জাজিরাকে আরো বলেন, তারা বেশ কিছু উন্নত অস্ত্র পেয়েছে, যার কিছু কিছু আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী রেখে গিয়েছিল। এসব অস্ত্র বিএলএর শক্তি বাড়িয়েছে। তাদের আক্রমণগুলো আরও মারাত্মক ও ধারালো করে তুলেছে।

ইসলামাবাদভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব পিস স্টাডিজ (পিআইপিএস) গত জানুয়ারিতে সতর্ক করে বলেছিল, বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি ভীষণ উদ্বেগজনক। এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, হামলার ঘটনা ১১৯ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর প্রদেশটিতে দেড়শর বেশি হামলা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বেলুচিস্তানে বড় ধরনের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করা হয়। তবে তা এখনো প্রারম্ভিক পর্যায়ে রয়েছে। মালিক সিরাজ আকবর বলেন, এমন হামলার পর বরাবরই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বড় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে এই দমন-পীড়নগুলো প্রায়ই নিরীহ বেলুচ বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হয়ে থাকে। বিএলএ কিংবা অন্য কোনো বিদ্রোহীদের সঙ্গে জড়িত না থেকেও তারা ভুক্তভোগী হন।

মালিক সিরাজ আকবর আরো বলেন, সরকারের কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে, তারা ন্যায়বিচারের চেয়ে লোকদেখানো উদ্যোগ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। মনে হচ্ছে, ক্যামেরার সামনে কয়েকটি মৃতদেহ দেখানোর মধ্য দিয়ে সরকারের কাজ শেষ হয়ে গেছে। তাই দ্রুত প্রতিশোধ নেওয়ার দাবি করা হচ্ছে।

এই বিশ্লেষকের মতে, বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে সামরিক বাহিনীর কিছুটা প্রতিকূল পরিস্থিতি রয়েছে।

মালিক সিরাজ আকবর আরো বলেন, বেলুচিস্তানে বিএলএর ক্রমবিকাশ ও রাষ্ট্রের গোয়েন্দা-ব্যর্থতার আরেকটি বড় কারণ, পুরো প্রদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এই গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের নখদর্পণে। বিপরীতে সামরিক বাহিনীর যেসব সদস্য বিদ্রোহ দমনে আসেন, তাদের বেশির ভাগকে পাঞ্জাব বা খাইবার পাখতুনখাওয়া থেকে আনা হয়। কাজেই তারা স্থানীয় বিএলএ যোদ্ধাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন।

পিপলসনিউজ/আরইউ

-- বিজ্ঞাপন --


CONTACT

ads@peoplenewsbd.com

বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে বিক্ষোভে কর্মচারীরা চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে বিক্ষোভে কর্মচারীরা এমআই সিক্সের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান হচ্ছেন ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি এমআই সিক্সের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান হচ্ছেন ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি ঈদযাত্রার ১৫ দিনে ৩৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৯০ জন ঈদযাত্রার ১৫ দিনে ৩৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৯০ জন করোনা পরীক্ষায় পুরোপুরি প্রস্তুত নয় সরকারি হাসপাতালগুলো করোনা পরীক্ষায় পুরোপুরি প্রস্তুত নয় সরকারি হাসপাতালগুলো