দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
অভ্যুত্থানের নয় মাস গেলেও বড় পরিবর্তন সহজ হচ্ছে না
প্রকাশ : ১৭-০৫-২০২৫ ১১:১১

ছবি : সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলসহ অনেকেই এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও বর্তমান সরকারের উপদেষ্টারা বারংবার বলছেন প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে হবে নির্বাচন।
তবে, এর আগে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার করে যেতে চাইছে সরকার। এজন্য ইতোমধ্যে বেশকিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। তবে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঙ্খিত সংস্কারের সে পথ সহজ হচ্ছে না মোটেই।
শুক্রবার (১৬ মে) এক প্রতিবেদনে এমনই এক বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। ‘আফটার দ্য রেভল্যুশন, বাংলাদেশ ইজ হোপিং টু রিফর্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে গণ-আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের পথ বেছে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিচারব্যবস্থা, সংবিধান এবং নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কারের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই বেশকিছু কমিশন গঠন করা হয়েছে, যাতে দেশের সুশীল সমাজ এবং একাডেমিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা যুক্ত আছেন।
এই কমিশনগুলোর সুপারিশ পর্যালোচনার জন্য গঠন করা হয়েছে আরো একটি সংস্থা- জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ কমিশন এখন পর্যন্ত ১৬৬টি সুপারিশ একত্রিত করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে মতামতের জন্য। ড. ইউনূস জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ৩৫টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দিয়েছে। এসব মতামতের ভিত্তিতে কমিশন একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করছে, যা নির্বাচনের পথ সুগম করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অবশ্য এই সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে মতবিরোধও রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কী ধরনের কমিশন থাকা উচিত ছিল- সে বিষয়ে সরকার কি যথাযথভাবে ভেবেছে? উদাহরণস্বরূপ, কেউ কেউ মনে করেন দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য একটি স্বতন্ত্র কমিশন থাকা উচিত ছিল।
আবার অনেকেই শিক্ষা খাতের প্রতি অবহেলা দেখিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সবচেয়ে বড় বিতর্ক দেখা দিয়েছে বিলম্বে গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ঘিরে। ওই কমিশনের এক প্রস্তাবে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হলে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপকভাবে প্রতিবাদে নামে।
তবু সংস্কারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ব্যক্তিরা আশাবাদী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের জন্য একটি স্বাধীন প্রক্রিয়া চালু করা। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, আগামী আগস্টের মধ্যেই একটি চূড়ান্ত সনদ প্রকাশ করা সম্ভব হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক ব্যবস্থায় কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখনো দুর্বল। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও রয়ে গেছে অস্থির। সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, জনগণের প্রায় ৬০ শতাংশ মনে করে, সরকার পরিবর্তনের পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। রাস্তায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ এখন যেন নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ বিক্ষোভে দেখা গেছে, দাবি একটাই— সাবেক শাসকদল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
এই প্রেক্ষাপটে, গত ১২ মে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে এবং তাদের আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যদিও দলটির জনপ্রিয়তা এখন অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত, তবু একে পুরোপুরি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ আরাফাত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, আওয়ামী লীগ ছিল জনগণের বৈধভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি, অথচ ‘জিহাদিরা’ সহিংস পন্থায় ক্ষমতা দখল করেছে। তিনি জানান, দলটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের ন্যায্য অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে।
দ্য ইকোনমিস্ট তার বিশ্লেষণে সতর্ক করেছে, ক্ষমতার বাইরে থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ এখনো সারাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। ফলে আগামী নির্বাচন, সরকার পরিচালনার ভবিষ্যৎ ও দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেকটাই নির্ভর করছে এই অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টার সফলতা এবং জাতীয় ঐকমত্য অর্জনের ওপর।
ড. ইউনূস নিজে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তার একমাত্র লক্ষ্য একটি নতুন, গণতান্ত্রিক, সুশাসনভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তবে, এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে যে পথে তারা হাঁটছেন, তা এখনো অনেক অনিশ্চয়তা, মতানৈক্য ও সময়ের পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com