এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদন
শত শত মুসলিমকে বাংলাদেশে বিতাড়িত করেছে ভারত
প্রকাশ : ২৪-০৭-২০২৫ ১২:২০

ছবি : সংগৃহীত
পিপলসনিউজ ডেস্ক
হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার সম্প্রতি শত শত জাতিগত বাঙালি মুসলিমকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই বাংলাদেশে বিতাড়ন করেছে। তাদের অনেকে ভারতেরই নাগরিক। তারা বাংলাদেশ-সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বাসিন্দা। ‘অবৈধ অভিবাসী’ অভিযোগে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে তাদের।
নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বুধবার (২৩ জুলাই) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।
চলতি বছরের মে মাস থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার বৈধ অনুমতি ছাড়া লোকজনের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর অজুহাতে জাতিগত এসব বাঙালি মুসলিমকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অভিযান জোরদার করেছে।
এইচআরডব্লিউ বলছে, এ ধরনের বেআইনি বিতাড়ন অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। এর পরিবর্তে সবার জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে; যাতে তারা বেআইনি আটক বা জবরদস্তিমূলক বিতাড়নের শিকার না হন।
সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, ভারতের শাসক দল বিজেপি ভারতীয়সহ জাতিগত বাঙালি মুসলিমদের নির্বিচার দেশ থেকে তাড়িয়ে বৈষম্যমূলক মনোভাব উসকে দিচ্ছে। সরকার বলছে, তারা অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলা করছে; কিন্তু তাদের যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি অবজ্ঞা, দেশীয় আইনে নিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড উপেক্ষা এ দাবিকে বিশ্বাসযোগ্য করে না।
গত জুন মাসে এইচআরডব্লিউ নয়টি মামলার ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ ১৮ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাদের অনেকে ভারতীয়, বাংলাদেশে বিতাড়িত হওয়ার পর ভারতে ফিরে গেছেন। আবার অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে এখনো নিখোঁজ। ৮ জুলাই সংস্থাটি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে চিঠি পাঠায়; কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ভারত সরকার বিতাড়িত ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করেনি। তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, গত ৭ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত ভারত থেকে এক হাজার ৫০০ জনের বেশি মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশুকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে মিয়ানমার থেকে ভারতে পালিয়ে আসা প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীও রয়েছেন। এই বিতাড়ন এখনো চলছে।
আসাম, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওডিশা ও রাজস্থান— বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর কর্তৃপক্ষ মুসলিমদের আটক করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের (বিএসএফ) হাতে তুলে দিচ্ছে। আটক ব্যক্তিরা মূলত দরিদ্র অভিবাসী শ্রমিক। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, সীমান্তরক্ষীরা আটক ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব যথাযথভাবে যাচাই না করে হুমকি দিয়ে ও পিটিয়ে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে অনেকে ভারতের নাগরিক বলে প্রমাণিত হওয়ায় দেশটির সরকার তাঁদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
এ অভিযানের সূচনা ঘটে গত এপ্রিল মাসে ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর এক হামলার পর। এরপর ভারতে মুসলিমদের হয়রানি, তাদের নাগরিকত্বের দাবি অগ্রাহ্য, ফোন ও কাগজপত্র জব্দ এবং স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। আটক ব্যক্তিদের কেউ কেউ বলছেন, বিএসএফ সদস্যরা তাদের হুমকি, মারধর ও অস্ত্রের মুখে সীমান্ত পার হতে বাধ্য করেছেন।
আসামের বাসিন্দা ও সাবেক স্কুলশিক্ষক খায়রুল ইসলাম (৫১) বলেন, ২৬ মে আমাকে বিএসএফ সদস্যরা হাত বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে ১৪ জনের সঙ্গে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠান। আমি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে মারধর করেন এবং চারবার ফাঁকা গুলি ছোড়েন। পরে তিনি দুই সপ্তাহের মাথায় ভারতে ফিরতে সক্ষম হন।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনিয়মিত অভিবাসন কয়েক দশক ধরে চললেও এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। রাজনীতি করার জন্য অনেক সময় এ সংখ্যা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয়। বিজেপির শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে বারবারই আখ্যায়িত করেন এবং এটিকে ব্যবহার করে হিন্দু ভোট আকর্ষণে ভারতের মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু বানান।
গত মে মাসে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজ্য সরকারগুলোকে ৩০ দিনের মধ্যে ‘অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত, চিহ্নিত ও বহিষ্কার করার’ নির্দেশ এবং প্রতিটি জেলায় আটককেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেয়। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুই হাজার ৩৬০ জনের নাম যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাঠিয়েছে তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশের পর বিজেপি-শাসিত কয়েকটি রাজ্যের কর্তৃপক্ষ বাংলাভাষী মুসলিম অভিবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় শুরু করে।
৮ মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারকে এক চিঠিতে এই ‘পুশইন’কে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করে ও জানায়, বাংলাদেশ শুধু যাচাই করা বাংলাদেশিদের গ্রহণ করবে এবং তাদের পুনর্বাসন অবশ্যই যথাযথ কূটনীতিক চ্যানেলের মাধ্যমে হতে হবে।
মে মাসে আসামের একটি আটককেন্দ্র থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) জানায়, আরো ৪০ রোহিঙ্গাকে সমুদ্রপথে মিয়ানমার সীমান্তের দিকে পাঠিয়ে দেয় এবং তাদের লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সাঁতরে উপকূলে পৌঁছাতে বাধ্য করে ভারত।
জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ এ ঘটনাকে ‘মানবিকতার অবমাননা’ ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শরণার্থীদের জোরপূর্বক দেশে ফেরত না পাঠানোর নীতির ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ বলে মন্তব্য করেন।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত চুক্তি এবং জাতিগত বৈষম্য বিলোপ সনদের আওতায় সবার অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব ভারত সরকারের রয়েছে। এ ছাড়া জাতি, বর্ণ, বংশ বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয় তাদের।
সংস্থাটি আরো বলেছে, যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে আটক ও বিতাড়ন করা ভারতের জন্য মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। যে কারো বিরুদ্ধে বিতাড়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাকে অবশ্যই যথাযথ তথ্য, দক্ষ আইনজীবী ও বহিষ্কার আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সীমান্তরক্ষীরা যেন অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে যেসব ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে, তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিতাড়নের জন্য আটক ব্যক্তিদের যথাযথ খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসা দেওয়া উচিত। নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ প্রয়োজন পূরণের পদক্ষেপ নিতে হবে।
পিয়ারসন বলেন, ‘ভারত সরকার যেভাবে কথিত অবৈধ অভিবাসীদের তাড়ানোর নামে হাজার হাজার মানুষকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে, তা মূলত মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতিরই প্রতিফলন। এ কাজ ভারতের ঐতিহাসিক আশ্রয়দানের সংস্কৃতিকেও কলঙ্কিত করছে।’
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com