আজ নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা
প্রকাশ : ০২-০৬-২০২৫ ১২:১৫

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার (২ জুন) বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারে পূর্ব-ধারণকৃত ভাষণের মাধ্যমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করবেন। এটি দেশের ৫৪তম এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সেই প্রেক্ষাপটে, দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এ বাজেটকে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একটি রূপরেখা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এবারের বাজেটের আকার সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা— যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের (সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা কম; অর্থাৎ শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ হ্রাস।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, স্থানীয় শিল্পকে সহজতর করা, কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এফডিআই আকর্ষণ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি, কর পরিপালন ঘাটতি কমানো, ভ্যাটের হিসাব ব্যবস্থা সহজীকরণের ওপর জোর দেওয়া হবে।
এ ছাড়া, ভ্যাট আদায়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পূরক শুল্ক হারকে যৌক্তিক করতে সংশ্লিষ্ট আইনের কিছু বিধান সরলীকরণের সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আর্থিক একীকরণের ওপর সরকারের অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আরো বাস্তবায়নযোগ্য ও দক্ষ আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ২০২৫-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট প্রণয়নের সময় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয় বিবেচনা করেছে। তাই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট হবে সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। এতে বাস্তবায়নযোগ্য পদ্ধতিও উল্লেখ থাকবে।
তিনি বলেন, আমি এই বাজেট (২০২৫-২৬ অর্থবছর) ছোট বলব না, তবে এটি অবশ্যই বাস্তবায়নযোগ্য ও সময়োপযোগী হবে। মুদ্রাস্ফীতি, বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ, রাজস্ব আহরণের মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে বলে এটি সময়োপযোগী হবে। আমরা এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করছি এবং এইভাবে বাজেটকে বাস্তবমুখী করে তুলছি।
জানা গেছে, রাজস্ব বাজেটের প্রায় ৫৭ শতাংশের সিংহভাগ অর্থ বেতন, ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ করা হতে পারে। শুধু বেতন-ভাতা ৮২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতাও চালু করা হতে পারে।
ভর্তুকি ব্যয় মোট এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে সুদ পরিশোধ রাজস্ব বাজেটের প্রায় ২২ শতাংশ হতে পারে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির চার শতাংশের নিচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে; যা চলতি অর্থবছরের দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা এবং জিডিপির তিন দশমিক ৬২ শতাংশ।
বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার বিদেশি ঋণ, ব্যাংক ঋণ এবং সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভর করবে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য পাঁচ দশমিক পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশের সম্ভাব্য মাঝারি জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে; যা চলতি বছরের জন্য সংশোধিত পাঁচ দশমিক ২৫ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি।
বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একটি অগ্রাধিকার হিসেবে থাকবে এবং সরকার এটিকে প্রায় ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রাখবে।
নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর ওপর আর্থিক চাপ কমাতে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির সম্প্রসারণ, সুবিধাভোগীর সংখ্যা এবং ভাতার পরিমাণ উভয়ই বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে; যা চলতি অর্থবছরের দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কম। তবে তা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরো মনোযোগী পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আশ্বাস দিয়েছেন, আসন্ন বাজেট ব্যবসা-বান্ধব হবে এবং বিনিয়োগ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পিত করনীতি প্রবর্তন করা হবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; যা চলতি অর্থবছরের চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা থেকে বেশি।
ঋণ পরিষেবা, খাদ্য ভর্তুকি ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের জন্য প্রধান বরাদ্দ রেখে অনুন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। অনুন্নয়ন বাজেট পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে; যা চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের তুলনায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।
সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনাও করছে। এ ছাড়া, কৃষি, সার ও বিদ্যুতের জন্য ভর্তুকিতে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে।
আগামী বাজেটে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস ও স্বল্পোন্নত ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্তরে উন্নীতকরণের প্রয়োজনীয়তার সাথে করনীতিগুলোকে সামঞ্জস্য করার পদক্ষেপও দেখা যেতে পারে।
বাজেটে সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও বাজেট ঘাটতি কমানোর ওপর জোর দেওয়া হবে। এমন কোনো ব্যয় থাকবে না, যা সাময়িকভাবে জনসাধারণকে সন্তুষ্ট করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যতের বাজেটের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেবে।
উন্নয়ন বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না এবং মাতারবাড়ি উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়া কোনো নতুন মেগা প্রকল্প শুরু করা হচ্ছে না।মাতারবাড়ি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পটি জাপানি ঋণে অর্থায়ন করা হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রকৃতির। ঋণের বোঝা বৃদ্ধি এড়াতে কোনো স্বল্পমেয়াদি বা উচ্চ-সুদের ঋণ নেওয়া হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় দরকার। মৌসুমি সবজির কারণে বাজারে সরবরাহ বাড়ায় গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ায় আবারো জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। পণ্যের সরবরাহ ঠিক না থাকলে শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্যোগ কাজে দেবে না। আবার উচ্চ সদুহার বিনিয়োগকেও বাধাগ্রস্ত করছে। অবশ্য বিনিয়োগ কমার আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
তিনি আরো বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে তা নিচের দিকে থাকা করদাতাদের জন্য স্বস্তি নিয়ে আসত। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার ছিল। সার্বিকভাবে নতুন বাজেটের গুণগত পরিবর্তন নিয়ে তিনি খুব বেশি আশাবাদী নন। অথচ বড় ধরনের পরিবর্তনের সুযোগ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি গত আট-নয় মাসে একধরনের স্থিতিশীল অবস্থার দিকে এগিয়ে গেছে। যদিও সাফল্যটা এসেছে মূলত বহির্বাণিজ্য খাত বা এক্সটারনাল খাতে। যেমন বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধ করা হয়েছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে, টাকার মূল্যমান স্থির হয়েছে, রিজার্ভ বেড়েছে। তবে এখনো বড় সমস্যা রয়ে গেছে এর আর্থিক কাঠামোর ক্ষেত্রে।
তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া যদি অব্যাহত থাকে, যদি গোপনে টাকা ছাপানো হয়, তাহলে তো সমস্যা আরো বাড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে বাজেটে ব্যয়ের ক্ষেত্রে হয়তো সংযত হওয়ার একটা চেষ্টা থাকবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কোথায় কোথায় সংযত থাকা লাগবে। একদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের মহার্ঘ ভাতা দিয়ে, অন্যদিকে যদি কৃষকের ভর্তুকি কমানো হয়, তাহলেই তো সমস্যা। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাজেটে প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযত ভাবটা আরো টেকসই ও সুষম করা। তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই স্থিতিশীলতাকে প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে অর্থনীতি যে অনেকটাই স্থিতিশীলতার দিকে সংহত হয়েছে, তা ব্যক্তি বিনিয়োগ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়াতে পারবে কিনা। এখন মূল লক্ষ্যই হওয়া উচিত বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো।
উল্লেখ্য, এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো টেলিভিশনে বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে। এর আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে টেলিভিশনে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ একবার অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট ঘোষণা করেছিলেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, ঘোষিত বাজেট অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট www.mof.gov.bd এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওয়েবসাইট www.nbr.gov.bd-এ বাজেটের সব তথ্যাদি ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাঠ ও ডাউনলোড করতে পারবেন। পাশাপাশি দেশ বা বিদেশ থেকে budgetfeedback@finance.gov.bd-এ ই-মেইলের মাধ্যমে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ পাঠানো যাবে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com