করোনা-ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়া চোখ রাঙাচ্ছে
প্রকাশ : ২০-০৬-২০২৫ ১৪:১২

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। অন্যদিকে করোনার সংক্রমণও নতুন করে বাড়ছে। এই দুই ভাইরাসজনিত রোগের সঙ্গে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে চিকুনগুনিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসজনিত এই তিনটি রোগের লক্ষণ প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় সচেতনতা এবং আগেভাগে সঠিক রোগ নির্ণয় অত্যন্ত জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪৫০ জন জ্বরে আক্রান্ত রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে; যার মধ্যে ১৫০ জনের শরীরে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, প্রায় ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগীর মধ্যে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ পাওয়া গেছে।
এদিকে, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকার ১৩টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর বিস্তার সবচেয়ে বেশি। ‘মৌসুম পূর্ব এডিস সার্ভে ২০২৫’ শীর্ষক জরিপে তারা উল্লেখ করেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন এবং কুষ্টিয়া, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ ও মাগুরা পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্বের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা ওই জরিপে দেখা যায়, নির্বাচিত এলাকাগুলোর তিন হাজার ১৪৭টি বাসাবাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে মোট ৪৬৩টিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে ঢাকার ১৩টি ওয়ার্ডে, যেখানে ১০০টি পাত্রের মধ্যে ২০টিরও বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ফলে এলাকাগুলোকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো— ২, ৮, ১২, ১৩, ২২ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৩, ৪, ২৩, ৩১, ৪১, ৪৬ ও ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। জরিপে আরো দেখা যায়, ঢাকার বহুতল ভবনেই সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এছাড়া ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে, নয় দশমিক আট শতাংশ একক বাড়িতে, আট দশমিক ৮৮ শতাংশ সেমিপাকা বাড়িতে এবং দুই দশমিক আট শতাংশ ফাঁকা জায়গায় লার্ভা পাওয়া গেছে।
জলজ পাত্র হিসেবে ফুলের টব ও ট্রেতে জমা পানি এডিস মশার বংশবিস্তারের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মোট সংগ্রহকৃত লার্ভার ২৭ শতাংশই এসব জায়গায় পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ২২ শতাংশ সিমেন্টের পানির ট্যাংকে, ২০ শতাংশ ফ্লোরে জমা পানিতে, ১৩ শতাংশ প্লাস্টিকের ড্রামে, ১১ শতাংশ লোহার পাইপে এবং ১০ শতাংশ প্লাস্টিকের পাত্রে পাওয়া গেছে।
আইইডিসিআর-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ঢাকায় বহুতল ভবনে সবচেয়ে বেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার মধ্যে ডেঙ্গুর মূল বাহক হচ্ছে এডিস অ্যাজিপ্টাই মশা, আর ঢাকার বাইরে এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। জেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে ঝিনাইদহ পৌরসভায়—সেখানে ২৭০টি বাড়ির মধ্যে ১৬২টিতেই লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এরপর মাগুরায় ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, পিরোজপুরে ২০ শতাংশ এবং পটুয়াখালীতে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা শনাক্ত করা হয়েছে।
ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, বরগুনার মতো জেলাগুলোতে যেখানে খাবার পানির সংকট রয়েছে, সেখানে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হয়। কিন্তু অনেকেই সেই পানির পাত্র ঢেকে রাখেন না, ফলে সেখানে সহজেই এডিস মশা জন্মায়। এ জন্য বাড়ি মালিক সমিতিকে সচেতন করতে হবে এবং কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে মশক নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাতে হবে। এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য অংশীজনদেরও যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, একটি পরীক্ষাতেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব। যদিও চলতি বছর এখন পর্যন্ত কোনো জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়নি, তবে গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রোগীর মধ্যে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হচ্ছে এবং এ বছর ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগীর মধ্যে এই রোগটির সংক্রমণ মিলেছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু হচ্ছে, চিকুনগুনিয়া হচ্ছে, মাঝে মাঝে করোনা শনাক্ত হচ্ছে—সবই ভাইরাসজনিত। এসব রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সবচেয়ে জরুরি। তিনি বলেন, এডিস মশা মূলত গৃহস্থালি মশা। এটি ঘরের ভেতরে ও বাইরে উভয় স্থানেই জন্মায়। ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টব, ছাদ বাগান, এমনকি অনেক সময় ব্যবহৃত না হওয়া বাথরুমের জমা পানিতেও এডিস মশা ডিম পাড়ে। তাই ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা, বাচ্চাদের ফুল প্যান্ট পরানো এবং দিন-রাত মশারি ব্যবহার করাই একমাত্র পথ।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com