খাগড়াছড়ি থমথমে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আগুনের ক্ষত
প্রকাশ : ৩০-০৯-২০২৫ ১১:০০

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এবং প্রাণহানির ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। সহিংসতায় গুলিতে তিনজন নিহত এবং সেনাবাহিনীর এক মেজরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক নাগরিকসহ বহু মানুষ আহত হয়েছেন। ১৪৪ ধারা জারি থাকলেও সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চলে।
জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে গুইমারার রামেসু বাজার। এ বাজারে ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জেলাজুড়ে সোমবারও (২৯ সেপ্টেম্বর) ছিল থমথমে পরিবশে, মোতায়েন রয়েছে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে খাগড়াছড়ি-সাজেকের পর্যটন যাত্রা; শত শত বুকিং বাতিল হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়েছে পূজার ছুটিকে ঘিরে সাজেকের পর্যটন ব্যবসা। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) থেকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘটনার পেছনে ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, খাগড়াছড়িতে স্কুল শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে সোমবারও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব আসামিদের গ্রেপ্তার ও বিচারসহ আট দফা দাবিতে তিন পার্বত্য জেলায় অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ডেকেছে জুম্ম ছাত্র-জনতা। এদিকে জুম্ম ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে শুধুমাত্র খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি-ঢাকা এ দুই সড়কে অবরোধ শিথিল করা হয়েছে। সোমবার তৃতীয় দিনের মতো খাগড়াছড়িতে জেলা সদর, সদর উপজেলা পৌর এলাকা এবং গুইমারা উপজেলায় টানা তৃতীয় দিনের মতো ১৪৪ ধারা জারি থাকে।
জুম্ম ছাত্র-জনতার এক মুখপাত্র বলেন, গুইমারায় গুলিতে ও নির্যাতনে আহত ভাই-বোনদের উন্নত চিকিৎসা এবং মরদেহ সৎকারের সুবিধার্থে ঢাকা-খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি সড়কে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দুপুর ১২টা থেকে সড়ক অবরোধ শিথিল করা হয়েছে।
সোমবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। দুপুর পর্যন্ত কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সকালে খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি থমথমে। শহরে দুই একটা টমটম চললেও কোনো দোকানপাট খোলা ছিল না। তবে অবরোধ শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে কিছু বাস, ট্রাক ও আটকেপড়া গাড়ি ছেড়ে গেছে।
এদিকে ডাকা অবরোধে রাঙ্গামাটির সঙ্গে যান চলাচল সোমবারও বন্ধ ছিল। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গাসহ নয় উপজেলার সঙ্গেও জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। এসব পথে জরুরি সেবা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করেনি।
অবরোধের কারণে তিন দিন ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সাজেকে আটকে পড়া ৫১৮ জন পর্যটককে সেনা নিরাপত্তা সাজেক থেকে খাগড়াছড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। সোমবার দুপুরে তারা খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছান।খাগড়াছড়ি শহরের চেঙ্গী স্কয়ার, শাপলা চত্বর, কলেজ গেইট, স্বনির্ভর, জিরো মাইলে চেকপোস্ট বসিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। ১৪৪ ধারার মধ্যে চলাচলকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
খাগড়াছড়িতে চলমান এ উত্তেজনা শুরু হয় বুধবার; আগের দিন রাতে ‘অচেতন অবস্থায়’ ক্ষেত থেকে এক মারমা কিশোরীকে উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মঙ্গলবার রাতেই ওই কিশোরীর বাবা ধর্ষণের অভিযোগে সদর থানায় মামলা করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন ভোরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর মধ্যে ধর্ষণের প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় খাগড়াছড়িতে। এই আন্দোলন এক সময় সহিংস হয়ে ওঠে। ১৪৪ ধারা জারির পাশাপাশি অতিরিক্ত সেনা ও বিজিবি মোতায়েনের পরও পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। রবিবার ১৪৪ ধারার মধ্যেই গুইমারায় ব্যাপক সহিংসতা হয়। সেখানে গুলিতে নিহত হন তিনজন। রবিবারের সংঘাতে সেনাবাহিনীর একজন মেজরসহ ১৬ সদস্য এবং গুইমারা থানার ওসিসহ তিনজন আহত হন।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবীব পলাশ বলেছেন, নিহতদের ময়নাতদন্ত ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আহতদের মধ্যে একজনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
গুইমারা থানার ওসি মো. এনামুল হক চৌধুরী বলেন, সোমবার সকাল থেকে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল চলে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কোথাও পিকেটিংয়ের খবর পাওয়া যায়নি।
খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদ বলেন, রবিবার থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ১৪ জন আহত রোগীকে নিয়ে আসা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে রবিবার রাতে চট্টগ্রামে রেফার্ড করা হয়েছে। বর্তমানে ১৩ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এছাড়া তিনজনের মরদেহ আনা হয়েছে।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরোফিন জুয়েল বলেন, সোমবার সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল অব্যাহত আছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে।
গুইমারায় নিহত তিনজনের পরিচয় জানাল পুলিশ: মারমা স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় খাগড়াছড়ির গুইমারায় নিহত তিনজনের পরিচয় প্রকাশ করেছে পুলিশ। তিনজনই গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নে বসবাস করতেন; তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। নিহত তিনজন হলেন- রামসু বাজার এলাকার আলাকাই মারমার ছেলে তৈইচিং মারমা (২০), আমতলী পাড়ার থুহলাঅং মারমার ছেলে আথুইপ্রু মারমা (২১) ও চেং গুলি পাড়ার হাসু মারমার ছেলে আখ্রাউ মারমা (২২)।
খাগড়াছড়ির ঘটনার পেছনে ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধন রয়েছে-স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে উদ্যাপনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটি মহল অনুষ্ঠানটি ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, খাগড়াছড়ির ঘটনাটি ভারতের ইন্ধনে ঘটছে।
সোমবার রাজধানীর পুরাতন রমনা থানা চত্বরে আদাবর, কদমতলী, ভাষানটেক, রমনা ও রামপুরা থানার ভবন নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, একটি মহল খাগড়াছড়িতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে এই ঘটনা ঘটছে। আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা ঘটনাস্থলে আছেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
তিনি আরো বলেন, কিছু সন্ত্রাসী পাহাড়ের ওপর থেকে গুলি চালাচ্ছে। এসব অস্ত্র অনেক সময় দেশের বাইরে থেকে আসে।সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, খাগড়াছড়িতে আটকে পড়া পর্যটকদের অধিকাংশকে এরই মধ্যে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে সহিংসতায় প্রাণহানির কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করার দাবি আসকের: খাগড়াছড়িতে সহিংসতায় তিনজনের মৃত্যু, বেশ কয়েকজনের আহত হওয়া এবং সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। একই সঙ্গে ধর্ষণের শিকার কিশোরী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রমাণভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি। সোমবার এক বিবৃতিতে এই দাবি জানায় আসক।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অবিলম্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, একই সঙ্গে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।’ এতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করা। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এর পরিণতি পুরো সমাজকেই বহন করতে হবে।’ তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকলে তাৎক্ষণিক তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানিয়েছে আসক।
দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে-মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা: পার্বত্য চট্টগ্রাম খাগড়াছড়িতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে আমি শুনেছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন আছে তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে যারা দোষী তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবে।
সোমবার সকালে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন শেষে এমন কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম।
যে বার্তা দিলেন জামায়াত আমির: খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ, সহিংসতা ও হতাততের ঘটনায় তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি এ আহ্বান জানান।
জামায়াত আমির বলেন, খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন এবং একজন মেজরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য আহত হয়েছেন। এগুলো কীসের লক্ষণ? হঠাৎ করে পাহাড়ে এমন অস্থিরতার নেপথ্যে কারা আছে?
তিনি বলেন, অবিলম্বে উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের পেছনে কোনো ক্রীড়নক থাকলে তাকেও খুঁজে বের করতে হবে।
‘এককাপড়ে বের হয়েছিলাম, এখনো সেভাবে আছি’: পোড়া বাড়ির সমানে বসে আছেন চিয়া প্রু মারমা (২১)। আগুনে পুড়ে পুরোটা ছাই হয়ে গেছে তাদের আধা পাকা ঘরটি। সেখানে পড়ে আছে পোড়া নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। জানালা পুড়ে কয়লা। দেয়ালে পোড়া চিহ্ন। যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে।
সোমবার দুপুরের দিকে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজারে এলাকায় দেখা যায় এই দৃশ্য। রবিবার বিক্ষোভ ও সহিংসতার সময় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বাড়িটি।
বসতবাড়ি হারিয়ে মা, বাবা ও বোনদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় বাড়ির সামনে বসে ছিলেন চিয়া প্রু মারমা। পুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নার্সিং কলেজপড়ুয়া এই ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘অবরোধে আমাদের পাড়ার কেউ অংশ নেননি। আমরা কিছুই করিনি। এরপরও বাইরে থেকে এসে লোকজন আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের কিছুই রাখেননি। এমনকি বই, কলম খাতাও পুড়িয়ে ফেলছে। একটা জিনিস পর্যন্ত নেই। এককাপড়ে যেভাবে বের হয়ে গিয়েছিলাম, সেভাবেই আছি এখনো।’
কারা আগুন জ্বালিয়েছে, তা বলতে পারবেন না বলে জানান চিয়া প্রু মারমা। তবে মানুষের কাছ থেকে শুনেছেন স্থানীয় বাঙালিরা তাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
সহিংসতার সময় গোলাগুলির শব্দ শুনে সবাই ঘরে দরজা লাগিয়ে বসেছিলেন বলে জানান তিনি। এরপর একপর্যায়ে ঘর থেকে মা-বাবা বোনদের নিয়ে ভয়ে চলে যান। এরপর এসে দেখেন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদের বসতবাড়ি।
চিয়া প্রু মারমার বাবা মূলত কৃষক। এর পাশাপাশি দোকানও রয়েছে। তাদের বাড়িটি আধা পাকা। সামনে প্রশস্ত উঠান। বাড়ির আঙিনাজুড়ে গাছের সারি। নানা ধরনের বৃক্ষরাজিতে ভরা বাড়ির প্রাঙ্গণ। আম, লিচু, সুপারি, নারিকেলগাছের সমাহার। আগুনের লেলিহান শিখার উত্তাপ ছুয়ে গেছে নিরীহ বৃক্ষরাজির ওপর। আগুনে পোড়া গাছগুলো মানুষের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে পাহাড়ি সংগঠন ‘জুম্ম-ছাত্র জনতা’। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রবিবার গুইমারার রামেসু বাজারে বিক্ষোভ ও সহিংসতা ঘটে। পাহাড়িদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় একটি পক্ষ।
বিক্ষোভ ও সহিংসতা চলাকালে তিন পাহাড়ির মৃত্যু হয়। সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অনেকে। এ সময় আগুনে পুড়ে যায় বাজারের দোকানপাট ও বাড়িঘর।
চিয়া প্রু মারমাদের বাড়ি থেকে বের হলেই রামেসু বাজার। সেই রামেসু বাজারের অবস্থা আরো খারাপ। সড়কের দুই পাশে থাকা দোকানপাট ও বসতঘর পুরোপুরি পুড়ে গেছে। শুধু আগুনে পোড়া অবকাঠামোগুলো কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোথাও তাও নেই। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে সব। আগুনে পুড়ে যাওয়া ধুলা উড়ছে। রাস্তা ও রাস্তার পাশে পড়ে ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া মোটরসাইকেলগুলো।
আগুনের উত্তাপ কমে গেলেও উত্তেজনা কমেনি পাড়াবাসীর মধ্যে। আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া দোকানঘরের সামনে অবস্থান করছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা।
তাদেরই একজন পাইসং মারমা। গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই বৃদ্ধা। পাড়ার লোকজন জানান, আগুনে তার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাড়ার বাসিন্দারা জানান, গুইমারার রামেসু বাজার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। খাগড়াছড়ি শহরসহ আশপাশের উপজেলার লোকজন কাপড় কিনতে এখানে ছুটে আসেন। এবারের আগুনে কাপড়ের দোকানগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রামেসু বাজার পাড়ার বাসিন্দা সাহ্লাপ্রু মারমা বলেন, কারা হামলা করেছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাহাড়ি বাঙালির মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। তাই বুঝে নেন পাহাড়িদের পাড়ায় কারা আগুন দিয়েছে। আগুনে অন্তুত ৪০টি দোকান, ৫০টি বসতবাড়ি পুড়ে গেছে। কিছু গুদামও পুড়েছে। শুধু পাহাড়িদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়েছে সেটি নয়, এখানে থাকা বাঙালিদেরও ঘর পুড়েছে। আগুনে এসব ঘরের কিছুই নেই। সব পুড়ে গেছে। মোটরসাইকেল পুড়েছে ১৮টি। মানুষের ঘরবাড়িতে থাকা গরু-ছাগলও লুট করে নিয়ে গেছে।
আগুনে পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিদেরও দোকান ও প্রতিষ্ঠান ভবন পুড়েছে। বাজারের প্রবেশ মুখে গণেশ ঘোষ ও সুমন ঘোষদের পারিবারিক মালিকানাধীন দুটি ভবন, একটি করাতকল, একটি হলুদের গুদাম পুড়ে গেছে আগুনে।
আর পাহাড়িদের বাড়ি ও দোকানপাটে বাঙালিদের আগুন দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন গুইমারার স্থানীয় বাসিন্দা ওষুধ দোকানি হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর মেজরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার কারণে স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তবে লোকজন কোথাও আগুন দেননি।
খাগড়াছড়ি ও সাজেক পর্যটক শূন্য, পুজার ছুটির সব বুকিং বাতিল: খাগড়াছড়িতে সহিংসতার প্রেক্ষাপটে সংকটে পড়েছে পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন; বিশেষ করে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় রাঙ্গামাটির সাজেক পর্যটক শূন্য হয়ে গেছে। কারণ খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকে যাওয়ার পথ তুলনামূলক সহজ হওয়ায় পর্যটকরা এ পথেই বেশী সাজেক যান।
সহিংসতার জের ধরে জেলা প্রশাসনের ঘোষণা করা ১৪৪ ধারা এবং আন্দোলনকারীদের ‘পর্যটন সাময়িক বন্ধের’ ঘোষণার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চলতি সপ্তাহের পুজোর ছুটিকে সামনে রেখে সেখানকার শ খানেক রিসোর্টের সব ফুল বুকড থাকলেও এখন সব বুকিং ক্যান্সেল হচ্ছে বলে জানিয়েছে সাজেক কটেজ অ্যান্ড রিসোর্ট ওনার্স এসোসিয়েশন।
অবশ্য বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে অন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলো খোলা আছে এবং সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় অনেক পর্যটক শুক্রবার সকাল থেকে ওই দুই জেলায় পৌঁছাতে শুরু করেন। তবে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তিন জেলার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র সাজেক থেকে দুই হাজারের বেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরায় সদরে ফিরে আসতে হয়েছে।
শহরের হোটেলগুলোও ফাঁকা হয়ে গেছে। একটি হোটেলের ব্যবস্থাপক বলছেন, শুক্রবার থেকে আগামী চলতি সপ্তাহে সব বুকিং বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। সেখানকার অধিকাংশ হোটেলেরই একই অবস্থা বলে জানিয়েছেন তিনি।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার অবশ্য বলছেন যে তারা আশা করছেন দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক যাওয়া সুবিধাজনক হলেও সাজেক ভ্যালি মূলত রাঙ্গামাটি জেলার সবচেয়ে উত্তরে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন। এর উত্তর ও পূর্ব দিকে ভারতীয় সীমান্ত আছে। রুইলুইপাড়া ও কংলাক পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে সাজেক। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়ার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭২০ ফুট । আর ১৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কংলাক পাহাড়-এ কংলাক পাড়া অবস্থিত। সাজেকে মূলত লুসাই, পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা আদিবাসী বসবাস করে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার, যা এখন কার্যত বন্ধ হয়ে আছে।
খাগড়াছড়ি ও সাজেকের রিসোর্ট ও হোটেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি সপ্তাহে পূজার ছুটির জন্য তারা অনেক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সাজেক কটেজ অ্যান্ড রিসোর্ট ওনার্স এসোসিয়েশন বলছে, সেখানে এখন মোট ৮৫টি রিসোর্ট আছে। আর সদরে জেলা প্রশাসনের হিসেবে বেসরকারি হোটেল আছে আরো অন্তত ২০টি। এর বাইরে সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানেও ছুটির সময়গুলোকে পর্যটকরা ভিড় করেন।
খাগড়াছড়ি সদরে সুপরিচিত একটি আবাসিক হোটেল হলো হোটেল গাইরিং। এর ব্যবস্থাপক প্রান্ত বিকাশ ত্রিপুরা বলছেন, তাদের হোটেল এখন পুরোপুরি খালি। চলতি সপ্তাহের সব বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। হোটেল এখন সম্পূর্ণ খালি, বলেন তিনি।
অন্যদিকে সাজেক কটেজ অ্যান্ড রিসোর্ট ওনার্স এসোসিয়েশনের সহ-প্রচার সম্পাদক মাইনুজ্জামান সরকার বলছেন, সাজেকের ৮৫টি রিসোর্টে মোট ২৬০০-৩০০০ বুকিং ছিলো।
ফুল বুকড ছিলো। এখন যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যটকরা কেউ বলছেন তারা পরে যাবেন। কিন্তু অনেকেই টাকা ফেরত চাইছেন। পর্যটক শূন্যতার কারণে পূজার বন্ধের ব্যবসা একেবারেই শেষ হয়ে গেছে, বলেন তিনি।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com