ডাকসু’র ভোটগ্রহণ শুরু
প্রকাশ : ০৯-০৯-২০২৫ ১১:০১

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এর আগে সবার উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্স সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটায় আটটি কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স খুলে সবাইকে দেখিয়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়। এ সময় গণমাধ্যমকর্মী এবং প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টরা উপস্থিত ছিলেন।
নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী কেন্দ্রীয় এবং হল সংসদের দুইটি বাক্স সিলগালা করে দেন। এ সময় তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন ব্যালট বাক্স সম্পূর্ণ ফাঁকা রেখে সিলগালা করা হয়েছে। এর মধ্যে বড় বাক্সটি কেন্দ্রীয় সংসদ এবং ছোটটি হল সংসদের জন্য। ভোটগ্রহণ শেষে যখন ভোট গণনা হবে, তখন সবাইকে নিয়ে বাক্সটি খোলা হবে।
কোন পদে কতজন লড়ছেন: এবার ডাকসুর ২৮টি পদের বিপরীতে মোট ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে নারী প্রার্থী আছেন ৬২ জন। মোট ৪৭১ জন প্রার্থীর মধ্যে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ৪৫ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৯ জন, সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ২৫ জন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ১৭ জন, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ১১ জন, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে ১৪ জন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১৯ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১২ জন, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে নয়জন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১৩ জন, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ১২ জন, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৭ জন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ১৫ জন, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে ১১ জন এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে ১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া ১৩টি সদস্য পদে ২১৭ জন প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে ১৮টি হল সংসদে ১৩টি পদে মোট এক হাজার ৩৫ জন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
বিভিন্ন হলে প্রার্থীর সংখ্যা হলো— ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ৫৯ জন, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ৩১ জন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৬২ জন, জগন্নাথ হলে ৫৫ জন, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৫৮ জন, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৭৫ জন, রোকেয়া হলে ৪৫ জন, সূর্যসেন হলে ৭৫ জন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৬০ জন, শামসুন নাহার হলে ৩৫ জন, কবি জসীম উদ্দীন হলে ৬৮ জন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৭৩ জন, শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৫৯ জন, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৩৬ জন, অমর একুশে হলে ৭৬ জন, কবি সুফিয়া কামাল হলে ৩৮ জন, বিজয় একাত্তর হলে ৬৮ জন এবং স্যার এ এফ রহমান হলে ৬২ জন।
মোট প্যানেল নয়টি: এবারের ডাকসু নির্বাচনে নয়টি প্যানেল ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল, ছাত্রশিবিরের ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’, বামপন্থি শিক্ষার্থীদের ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’, স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ এবং তিনটি বামপন্থি সংগঠনের ‘অপরাজেয় ৭১ অদম্য ২৪’। এ ছাড়া কয়েকটি প্যানেল আংশিক মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।
ভোটকেন্দ্র কোথায়: নির্বাচনে মোট আটটি পৃথক ভোটকেন্দ্রের ৮১০টি বুথে ভোট গ্রহণ করা হবে। কেন্দ্রগুলো হলো, ১. কার্জন হলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল ও ফজলুল হক মুসলিম হল। ২. শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে জগন্নাথ হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। ৩. ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে রোকেয়া হল। ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্রে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। ৫. সিনেট ভবন কেন্দ্রে স্যার এ এফ রহমান হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও বিজয় একাত্তর হল। ৬. উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে সূর্যসেন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল ও কবি জসীম উদদীন হল । ৭. ভূতত্ত্ব বিভাগ কেন্দ্রে কবি সুফিয়া কামাল হল এবং ৮. ইউ ল্যাব স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে শামসুন নাহার হল।
যেভাবে ভোট দিবেন ভোটাররা: ভোটারদের তাদের সুবিধাজনক সময়ে নির্ধারিত ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে। এরপর ভোটকেন্দ্রে থাকা পোলিং কর্মকর্তাকে পরিচয় নিশ্চিত করবেন। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হলে তার লাইব্রেরি কার্ড অথবা পে-ইন স্লিপ দেখিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করা যাবে। অন্য বর্ষের শিক্ষার্থীরা হল আইডি কার্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি কার্ড দেখিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করবে। পরিচয় নিশ্চিতের পর ভোটারের আঙুলে অমোচনীয় কালির দাগ দেবেন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা। এরপর ভোটার তালিকায় নিজের নামের পাশে স্বাক্ষর করবেন ভোটার। তারপর পোলিং কর্মকর্তাকে ভোটার নম্বর জানাতে হবে। পরবর্তী ধাপে ব্যালট নিয়ে ভোটার প্রবেশ করবেন গোপন ভোট কক্ষে। ফোন বা কোনো ইলেকট্রনিকস ডিভাইস নিয়ে ভোট কক্ষে প্রবেশ করা যাবে না। ব্যালট পেপার থেকে পছন্দের প্রার্থীর নাম ও ব্যালট নম্বর খুঁজে বের করবেন ভোটার। এরপর পছন্দের প্রার্থীর নামের পাশের ঘরে স্পষ্টভাবে ক্রস চিহ্ন দেবেন। খেয়াল রাখতে হবে, ক্রস চিহ্নটি যেন ঘরের বাইরে না যায়। ভোটদান শেষে সেটি ব্যালট বাক্সে জমা দেবেন। কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদের জন্য দুটি আলাদা ব্যালট বক্স থাকবে। ব্যালট পেপার ভাঁজ না করে সেগুলো নির্ধারিত বাক্সে ফেলে ভোটার তার ভোটদানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন।
ডাকসু নির্বাচন জাতির জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করবে, বললেন ঢাবি ভিসি:ডাকসু নির্বাচন সমগ্র জাতির জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। সোমবার বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের দিকে পুরো দেশ তাকিয়ে আছে। বহু বছর পর আমরা একটা ঐতিহাসিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। ডাকসু নির্বাচন সমগ্র জাতির জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করবে। এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো আশঙ্কা নেই। এদিকে সোমবার এক ভিডিও বার্তায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ঢাবি উপাচার্য বলেন, ডাকসু তোমাদের অনুষ্ঠান, তোমরা গভীরভাবে চেয়েছো, তাই আমরা আয়োজন করেছি। নির্বাচনি প্রস্তুতি শেষ পথে। শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে ভোট দিতে আসবেন, আমরা অপেক্ষায় থাকব।
ডাকসু হবে একটি মডেল নির্বাচন, বললেন নির্বাচন কমিশনার: ডাকসু নির্বাচন হবে একটি মডেল নির্বাচন। বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করতে পারে এমন দৃষ্টান্ত ঢাবি শিক্ষার্থীরা তৈরি করবে। ডাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন এসব কথা বলেছেন। সোমবার বিকালে ডাকসু নির্বাচন কমিশন অফিসের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন ।
চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। কোনো ধরনের শঙ্কা আমরা দেখছি না। শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থী সবাই যেন ভোট দিতে আসে তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে। আমরা সকল অংশীজনের সহযোগিতা চাই যেন সুষ্ঠুভাবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারি।
নিরাপত্তাজনিত কোনো শঙ্কা নেই, বললেন ডিএমপি কমিশনার: ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তাজনিত কোনো শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী। নির্বাচন সুষ্ঠু রাখতে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ডিএমপির অস্থায়ী পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। ডিএমপি কমিশনার জানান, মঙ্গলবার দুই হাজার ৯৬ জন পুলিশ, ডগ স্কোয়াড, সোয়াট টিম, বিশেষায়িত টিম, সাদা পোশাকধারী ডিবি পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই।
ক্যাম্পাসে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত: এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে টানা তিন দিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ৮ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা থেকে ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলো শাহবাগ, পলাশী, দোয়েল চত্বর, শিববাড়ি ক্রসিং, ফুলার রোড, উদয়ন স্কুল ও নীলক্ষেত সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে। তবে বৈধ আইডি কার্ডধারী শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রবেশ করতে পারবেন। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর পরিচয়পত্রের ফটোকপি প্রদর্শন করে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত এবং জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন (অ্যাম্বুলেন্স, চিকিত্সক, রোগী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সাংবাদিক ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি) ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। ডাকসুতে একটা মডেল তৈরি হলে সেটি সারা দেশ অনুসরণ করতে পারবে।
ডাকসু প্রতিষ্ঠার ১০০ বছরের মাথায় এর ৩৮তম নির্বাচন আজ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বেশির ভাগ সময় ডাকসুর নির্বাচন হয়েছে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদগুলো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা ও অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন এবং নানা ধরনের প্রকাশনা বের করার কাজই বেশি করেছে। ষাটের দশকেও এসব হয়েছে।
তবে ষাটের দশকে শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ডাকসু ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক ভূমিকাই বড় হয়ে দেখা দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব তৈরিতে ডাকসুর ভূমিকা ছিল। যদিও স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে সবচেয়ে কম, মাত্র সাতবার।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com