ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, গ্রামে আক্রান্তের হার বেশি
প্রকাশ : ১৭-০৬-২০২৫ ১০:০২

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসেই আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। জুন মাসে এই প্রবণতা আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। জুনের প্রথম ১৬ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মে মাসের তুলনায় বেশি।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যদি এভাবে সংক্রমণ বাড়তেই থাকে, তবে আগামী জুলাইয়ের শেষ দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছাবে। পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক করে তুলেছে মশা নিধনে দুর্বল সরকারি উদ্যোগ এবং গ্রামাঞ্চলে এর বিস্তৃতি।
পরিস্থিতির একটি নতুন মাত্রা হলো, রাজধানী ঢাকা নয়— এবার ডেঙ্গুর বিস্তৃতি গ্রামাঞ্চলে বেশি। ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন কিছুটা কার্যক্রম চালালেও ঢাকার বাইরে তেমন কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেই। অনেক স্থানে ওষুধ ছিটানো হয় না, আবার যেখানে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তার গুণমান নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। ফলে সাধারণ মানুষ চরম উদ্বেগ ও অসহায়তায় ভুগছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু ভাইরাসের উপসর্গ এখন আর আগের মতো একরৈখিক নয়। ভাইরাসের আচরণ পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক রোগীর শরীরে জ্বরের তীব্রতা দেখা যাচ্ছে না, অথচ তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। অনেক ক্ষেত্রে টেস্টে রেজাল্ট ‘নেগেটিভ’ দেখালেও রোগী প্রকৃত অর্থে ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে। এ ধরনের অস্পষ্ট লক্ষণ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাকে জটিল করে তুলেছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রথমে জ্বর না থাকায় রোগীরা ঘরে বিশ্রামে থাকেন। পরে হঠাৎ করেই শারীরিক অবস্থা মারাত্মকভাবে খারাপ হয় এবং অনেকের আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে।
সোমবার (১৬ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন করে ২৩৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যদিও এ সময় কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি, তবু আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। আক্রান্তদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে সর্বাধিক ১১৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে অর্ধশতাধিক, ঢাকা বিভাগে ৩২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৯ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৮ জন, উত্তর সিটিতে ১৫ জন, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে পাঁচ জন করে এবং ময়মনসিংহ বিভাগে একজন আক্রান্ত হয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে মোট ছয় হাজার ২২২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন; যাদের মধ্যে মারা গেছেন অন্তত ৩০ জন। আক্রান্তদের ২৩ শতাংশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এবং বাকি ৭৭ শতাংশ ঢাকার বাইরে। আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশই বরিশাল বিভাগের; যার মধ্যে বরগুনা জেলায় সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনা বর্তমানে দেশের অন্যতম ডেঙ্গু ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত।
বরগুনা শহরজুড়ে দিন-রাত মশার উপদ্রব ভয়াবহ। স্থানীয়রা জানান, মশার কয়েল, ধূপ বা স্প্রে দিয়েও মশার উপদ্রব কমছে না। মশা মারার কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগের সাতটি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ১১৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বরগুনাতেই ৬৫ জন।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। আগে এডিস মশা মূলত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক থাকলেও এখন তা শহর ছাড়িয়ে গ্রামে চলে গেছে। একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি ঢাকা থেকে গ্রামে গেলে, তাকে কামড় দেওয়া ফ্রেশ মশার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে এখন গ্রামগুলোতে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে।
তিনি বলেন, সরকারকে দায় দিয়ে বসে থাকলে হবে না। জনগণেরও দায়িত্ব আছে। বাসাবাড়ির ছাদ, নির্মাণাধীন ভবন, এসির নিচে জমে থাকা পানি—এসবই এডিস মশার প্রজননের আদর্শ স্থান। তাই সবাইকে নিজ আঙিনা পরিষ্কার রাখতে হবে। শুধু সিটি করপোরেশনের ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গু ঠেকানো সম্ভব নয়।
বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু এখন মৌসুমি রোগ নয়, বরং সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে। এডিস মশার আচরণ ও জীবনচক্রে পরিবর্তন এসেছে। ডেঙ্গুর উপসর্গ বদলে গেছে, চিকিৎসার ধরনও পাল্টেছে। ফলে কেবল শহর নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই রোগ দাপট দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন মশা মারছে না— এই দোহাই দিয়ে নিজের বাড়ির আশপাশে পানি জমে থাকতে দিলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সবাইকে সচেতন হয়ে, সম্মিলিতভাবে মশা নিধনে কাজ করতে হবে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শফিউদ্দিন মোয়াজ বলেন, শিশুদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে, এবং তাদের ক্ষেত্রে রোগের ধরণ আরো বিপজ্জনক। ডেঙ্গুতে ব্যাক পেইন, র্যাশ, হেমোরেজিক উপসর্গের পাশাপাশি এখন জ্বর না থাকায় রোগ ধরা পড়ছে দেরিতে। অনেক শিশুই শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে এসে আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হচ্ছে। তিনি অভিভাবকদের পরামর্শ দেন, শিশুদের ফুলহাতা জামাকাপড় পরানো, ঘর পরিষ্কার রাখা এবং প্রচুর তরল জাতীয় খাবার খাওয়ানোর বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, তাদের সাড়ে এক হাজার ১০০’র বেশি কর্মী প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা মশা নিধনে কাজ করছেন। তিনি জানান, উত্তর সিটি করপোরেশনে মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে সফল হয়েছে। সোমবার মাত্র আটজন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে এই এলাকায়। তবে তিনি একে স্থায়ী সাফল্য মনে করছেন না। বরং জনসচেতনতার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, প্রতিটি নাগরিককে নিজের বাসা, আঙিনা এবং আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। জমে থাকা পানি নিজেরাই পরিষ্কার করলে মশার বংশবিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, নগরজীবনের অপরিকল্পিততা, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ এবং পানি নিষ্কাশনের দুর্বল ব্যবস্থাপনা মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছে। তিনি সতর্ক করেন, ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকনগুনিয়া, জিকা— এই ধরনের অন্যান্য মশাবাহিত রোগও সামনে ব্যাপক হারে দেখা দিতে পারে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একসঙ্গে একটি বার্তাই উঠে এসেছে— ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার, নাগরিক এবং সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
আসন্ন বর্ষা মৌসুম এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গুর প্রকোপ কীভাবে রূপ নেবে, তা সময়ই বলবে। তবে এখনই প্রতিরোধ না করলে এর পরিণাম হতে পারে মারাত্মক। সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি নাগরিককে দায়িত্ব নিতে হবে। ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, সচেতনতা বাড়ানো এবং মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com