নদীতে কেন মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ?
প্রকাশ : ০৭-০৭-২০২৫ ১১:৫৩

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
বর্তমানে বাজারে ইলিশের বিরাট সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে ও সাগরে দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞার পরও কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মিলছে না। বছরের পর বছর ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও এবার সেই ধারা অনেকটাই ভেঙে গেছে। বিশেষ করে, গত মে মাসের ১ তারিখ থেকে যখন নিষেধাজ্ঞার পর জেলেরা নদীতে ও সাগরে জাল ফেলতে নেমেছিলেন, তখন তাদের আশা ছিল, প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়বে। কিন্তু বাস্তবে তার বিপরীত ঘটেছে।
নদী ও সাগরে জাল ফেলেও বেশিরভাগ জেলে তীরে ফিরে এসেছেন খালি হাতে। জেলেরা প্রথমে বৃষ্টির অভাবকেই দায়ী করলেও বর্তমানে তাদের দাবির আঙ্গিক বদলেছে। তারা এখন বলছেন, অন্য অনেক কারণের কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ইলিশের সরবরাহ কম হওয়ায় এর দাম বেড়ে গিয়েছে; যা সাধারণ মানুষের কাছে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের মৎস্য বিভাগের মতে, এই সংকটের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো বড় কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ একটি গভীর জলের মাছ হওয়ায়, নদীর গভীরতা কমলে বা পানির তাপমাত্রা বাড়লে, তা তাদের প্রজনন ও চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করে। বিশেষত, নদীতে বা সাগরে বৃষ্টি ও পানিপ্রবাহের পরিমাণ বেড়ে গেলে ইলিশ মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বর্তমানে এই শর্তগুলো অনুকূল অবস্থায় নেই। আর জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর নিরাপত্তা সংকট, ডুবোচর তৈরি হওয়া এবং গবেষণার ঘাটতি এসবই ইলিশ উৎপাদন ব্যাহত করার মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইলিশ উৎপাদনের বৃহত্তম অঞ্চল হিসেবে পরিচিত বরিশাল, পিরোজপুর, এবং পাথরঘাটা এলাকার জেলেরা বর্তমানে আশাহত। তারা বলেন, এক সময় যেখানে প্রতি জাল ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মণকে মণ ইলিশ পাওয়া যেত, সেখানে এখন চার-পাঁচটি ইলিশও সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে, মিঠাপানির ইলিশ, যা বিশ্ববিখ্যাত, সেই ইলিশ পাওয়ার আশাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাদের মতে, এই সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে নদ-নদীর অভ্যন্তরে ডুবোচর সৃষ্টি হওয়া এবং চিরাচরিত মাছ ধরার পরিবেশে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের ফলে ইলিশের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হওয়া। এর সঙ্গে আবার নতুন একটি সমস্যা যোগ হয়েছে; যা হল রাসায়নিক দ্রব্যের অবৈধ ব্যবহার। কিছু অসাধু জেলে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মাছ শিকার করছেন, যার ফলে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন পোনাও বিপদগ্রস্ত হচ্ছে।
এ ছাড়া, সরকারের দেওয়া দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার পরও বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম থাকায় চাহিদা বাড়ে এবং ফলে দাম বেড়ে যায়। বিভিন্ন আড়ত থেকে ইলিশের সরবরাহ কমে যাওয়ায়, মানুষ সাধারণত নির্ধারিত দামে মাছ কিনতে পারছেন না এবং এটি সাধারণ মানুষকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সংকট শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কিত। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ও ভারতের সীমান্তের মধ্যে একে অপরের জলসীমায় ইলিশের প্রজনন সময়ের মধ্যে বিভেদ রয়েছে। ভারতীয় জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সময় বাংলাদেশি জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ বেড়েছে। ফলে, এমনভাবে ইলিশের উৎপাদন কমছে যে, এটি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
ইলিশ বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, বাংলাদেশের মিঠাপানির ইলিশের স্বাদ পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত। ইলিশ সাগরের লবণাক্ত পানি থেকে যখন নদ-নদীর মিঠা পানিতে প্রবাহিত হয়, তখন তার শরীরে একধরনের চর্বির আবরণ তৈরি হয়, যার ফলে ইলিশের স্বাদ অসাধারণ হয়। কিন্তু বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, ইলিশের এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীতে অবাধে মাছ ধরা বা খাল-বিলের দখল হওয়া, এ সবই ইলিশের প্রাকৃতিক অভ্যন্তরে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
ইলিশ গবেষক আনিসুর রহমান বলেন, বরিশাল অঞ্চলে নদী মোহনাগুলোর মধ্যে অসংখ্য চর তৈরি হওয়ায়, সেখানে ইলিশের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় শিল্পায়ন, বিশেষত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কারণে নদীর পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে, যা ইলিশের চলাচলে আরো বাধা সৃষ্টি করছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ইলিশের দাম যেন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, অবৈধভাবে মাছ ধরার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে এবং নিষিদ্ধ জাল ধ্বংস করার পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এই সংকটের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে নদীর নাব্য সংকটকেই সামনে আনছেন তিনি। তিনি বলেন, নাব্য সংকটের কারণে নদী ও সাগরের ইকো সিস্টেম পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তা ইলিশের প্রজনন ও চলাচলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল দুই লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। তবে ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টনে। তবে সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে যে, ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এই বছর পূর্ণ নাও হতে পারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন পাঁচ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছালেও, প্রকৃত সংকট এবং অব্যাহত চাহিদার কারণে এর দাম বাড়ছে এবং বাজারে ক্রমশ সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদন খাতে চলমান সংকট একটি বহুমুখী সমস্যা। এটি শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের ফল নয়, বরং অবৈধ মাছ ধরা, নদী নাব্য সংকট, শিল্পায়ন, এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপর নির্ভরশীল একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আর যদি এই সমস্যাগুলো সমাধান করা না যায়, তাহলে মিঠাপানির ইলিশের উৎপাদন ও সংরক্ষণ ভবিষ্যতে আরও বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com