শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা আজ
প্রকাশ : ১৩-১১-২০২৫ ১১:২১
ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় কবে দেওয়া হবে, তা জানা যাবে আজ বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর)।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী নামে পরিচিত) হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রথম দিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) এবং ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন।
একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ এই তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। সেগুলো হলো গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানোর অভিযোগ। এই পাঁচ অভিযোগে তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল দেশের বাইরে । সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের দিন (১০ জুলাই) সাবেক আইজিপি মামুন গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন এবং ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন।
গত ১২ অক্টোবর এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড চান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি যুক্তিতর্কে এ মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের খালাস আবেদন করেন। রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনেরও খালাস আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
এদিকে মামলার রায়ের দিন ঘোষণাকে ঘিরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানী ও দেশজুড়ে চরম উত্তেজনা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও গ্রামীণ ব্যাংকে আগুন দেওয়ার মতো একাধিক ঘটনা ঘটেছে। সরকার বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঢাকার প্রবেশমুখে কড়া তল্লাশি, বিমানবন্দরগুলোতে সতর্কতা জারি এবং রাজধানীসহ আশপাশের জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে; ছাত্রলীগ কয়েকটি ভবনে তালা দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ। রাজধানীতে গত একদিনে ৪৪ জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন ডিবির হাতে। অন্যদিকে মিরপুর, ধোলাইপাড়, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় একাধিক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, কর্মসূচি ঘিরে কোনো আতঙ্কের কারণ নেই; পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে আছে। তবে রাজনৈতিক মহলে আশঙ্কা, এই ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি নতুন করে উত্তেজনা, সহিংসতা ও সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।
কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ‘ঝটিকা মিছিল’ হয়েছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দিনটি ঘিরে চলছে নানা প্রচার-অপপ্রচার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৩ নভেম্বর কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে মূলত আলোচনায় আসার কৌশল রয়েছে দলটির। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনই এ কর্মসূচি সফল হবে, এটি মনে করেন না তারা। তবে অন্তর্বর্তী সরকারসহ তাদের পক্ষীয় সবাইকে আওয়ামী লীগের ঘোষিত লকডাউন কর্মসূচি নিয়ে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত করে তোলার পরিকল্পনা এটি।
লকডাউন কর্মসূচি ঘিরে সবাইকে ব্যস্ত রাখতে পেরেছে দাবি করে দলীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, ১৩ নভেম্বরের আওয়ামী লীগের কর্মসূচি আগেই সফল হয়ে গেছে।
দেশত্যাগ করা আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর কর্মসূচি ঘোষণা করার বিদেশি চাপও আছে। তা ছাড়া, দেশের সাধারণ মানুষসহ দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রতিক্রিয়াও দেখতে চান তারা। এ কর্মসূচি থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আগামীর রাজনৈতিক কর্মকৌশল গ্রহণ করবেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগের ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ওইদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে।
গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ১৩ নভেম্বর নিরাপত্তা আরো বাড়ানো হবে।
অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা এ মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দেবে বলে মনে করেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। বুধবার ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রসিকিউটর মিজানুল বলেন, তিনি নিঃসন্দেহে বলতে পারেন যে স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে একটা প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে তারা এটা বলছে।
আওয়ামী লীগের লকডাউনকে ঘিরে আজ সকাল থেকে রাজধানীতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরেজমিন রাজধানীর সব পয়েন্টে ব্যাপক পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সেনাবাহিনী টহলরত অবস্থায় আছে। রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করছে; তাও পরিমাণে কম। গণপরিবহন নেই বললেই চলে। মোড়ে মোড়ে জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com