ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে আইএমএফের প্রতিনিধিদল আসছে এ মাসে
প্রকাশ : ০৫-১০-২০২৫ ১১:৩৯

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে আবারো বাংলাদেশ সফরে আসছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিনিধিদল। আগামী ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভা শেষ হওয়ার পর ২৯ অক্টোবর ঢাকায় পৌঁছাবে আইএমএফের প্রতিনিধি দলটি। তারা টানা দুই সপ্তাহ অবস্থান করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি মূল্যায়ন করবে।
আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন ও সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে দলটি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক করবে। মূলত, ঋণ কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত দেওয়া পাঁচ কিস্তির সঙ্গে সম্পর্কিত শর্তসমূহ পূরণের অগ্রগতি তারা পর্যবেক্ষণ করবে। এজন্য প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে।
২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এরপর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তি হিসেবে ১১৫ কোটি ডলার এবং ২০২৫ সালের জুনে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি হিসেবে মোট ১৩৩ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।
সাত কিস্তিতে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে মোট ৪৭০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পেয়েছে ৩৬৪ কোটি ডলার। বাকি রয়েছে ১০৬ কোটি ডলার। গত জুন মাসে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ বাংলাদেশের ঋণ কর্মসূচির মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত ৮০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। ফলে ঋণ কর্মসূচির মোট পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫০ কোটি ডলারে এবং কিস্তির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে আটটি। নতুন সময়সূচি অনুযায়ী, এই কর্মসূচি শেষ হবে ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে। এতে বাংলাদেশ এখনো পেতে পারে মোট ১৮৬ কোটি ডলার।
আইএমএফের এবারের দল সংস্থাটির ‘পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড’ (কোয়ান্টিটেটিভ পারফরম্যান্স ক্রাইটারিয়া বা কিউপিসি) পূরণ নিয়ে বেশি আলোচনা করবে বলে জানা গেছে। কিউপিসি হচ্ছে আইএমএফের বাধ্যতামূলক শর্ত। গত মে মাসে আইএমএফ নতুন কিছু শর্ত যুক্ত করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদেশি ঋণ গ্রহণের সীমা নির্ধারণ, জ্বালানি ও সার আমদানির বকেয়া পরিশোধ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নির্দিষ্ট মান বজায় রাখা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।
আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮৪৪ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ নিতে পারবে না। সংস্থাটি প্রতি তিন মাস পরপর বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। জুন মাসের শেষে আইএমএফের শর্ত ছিল, বাংলাদেশের নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ (এনআইআর) থাকতে হবে অন্তত এক হাজার ৭৪০ কোটি ডলার। বাস্তবে ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় দুই হাজার ৭৩ বিলিয়ন ডলার; যা শর্ত পূরণের কাছাকাছি।
জ্বালানি ও সার আমদানির বকেয়া পরিশোধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে। তবে বড় দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে রাজস্ব আয়ে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল চার লাখ ৪৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রকৃত আদায় হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্য অর্জনে ঘাটতি রয়ে গেছে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, রাজস্ব আয়ের ঘাটতি এবারো একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আগেও তিনবার অর্জন করা যায়নি। এবারো না হলে আইএমএফের কাছ থেকে অব্যাহতি চাইতে হবে। তবে সেই অব্যাহতি আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে মুদ্রা বিনিময় হারের নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। আগে নির্দিষ্ট হার ঘোষণা করা হতো, এখন বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আবার ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিও আগের মডেলেই রয়েছে— এসব বিষয় নিয়েও আইএমএফ প্রশ্ন তুলতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ষষ্ঠ ও সপ্তম কিস্তিতে আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল ৫৩ কোটি ডলার করে। ষষ্ঠ কিস্তি পাওয়ার কথা আগামী ডিসেম্বরে। তবে বড়দিন উপলক্ষে ওই মাসে ওয়াশিংটনে সাধারণত দীর্ঘ ছুটি থাকে, ফলে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডিসেম্বরে হওয়ার সম্ভাবনা কম। এজন্য বৈঠকটি জানুয়ারিতে গড়াতে পারে। এরই মধ্যে কিস্তির পরিমাণও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে—ষষ্ঠ ও সপ্তম কিস্তিতে বাংলাদেশ পাবে ৪৩ কোটি ডলার করে। শেষ বা অষ্টম কিস্তি নির্ধারিত হয়েছে ১০০ কোটি ডলার; যা ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে ছাড় করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই মাসের শেষ দিকে আইএমএফের প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসবে। তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে বিশদ আলোচনা হবে। তবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছাড়া অন্যান্য শর্ত পূরণে তেমন কোনো সমস্যা নেই। তিনি আরো বলেন, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে কিস্তি ছাড়ে কিছু বিলম্ব হতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যাংক ও রাজস্ব খাতে সংস্কার বাস্তবায়ন। আমরা সেই কাজই করছি। কিস্তি পাওয়া নয়, টেকসই সংস্কারই এখন সবচেয়ে জরুরি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, আইএমএফের এবারের সফর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে যাচ্ছে। কারণ, রাজস্ব কাঠামো, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং মুদ্রানীতি— সবক্ষেত্রেই আইএমএফ এখন ঘনিষ্ঠ নজরদারি চালাবে। এই পর্যবেক্ষণের ফলাফলই নির্ধারণ করবে, ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড় পাবে কিনা।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের চাপ সামলাতে চেষ্টা করছে। এমন বাস্তবতায় আইএমএফের পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে বড় প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com