আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু হত্যার ৫০ বছর
প্রকাশ : ১৫-০৮-২০২৫ ১২:৩৯

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী আজ ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনে একদল বিপথগামী সেনাসদস্য তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সংঘটিত ইতিহাসের ঘৃণ্য ও নৃশংসতম সেই হত্যাকাণ্ডের ৫০ বছর আজ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে তার জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিল, এসবির কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান ও সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককে হত্যা করা হয়।
১৫ আগস্টের সেই রাতে সেনাসদস্যদের আরেকটি দল শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে যুবলীগের নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা করে তাকে ও তার কন্যা বেবি, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় আবদুল নঈম খানকে হত্যা করা হয়।
ওই সময় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থান করায় বেঁচে যান।
১৫ আগস্টের সেই হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর হত্যাকারীদের বিচার শুরু হয়। একই সঙ্গে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস এবং এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। পরে উচ্চ আদালত ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এখন পর্যন্ত ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। একজন বিদেশে মারা গেছেন। পাঁচজন এখনো পলাতক।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এ দফায় টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে ঘিরে মাসব্যাপী কর্মসূচি পালন করত। ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার কবরে শ্রদ্ধা জানানোসহ নানা আয়োজন করা হতো।
গত বছর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে এখন আর সরকারি ছুটি নেই। গত বছর এই ছুটি বাতিল করা হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের দিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। এর ছয় মাস পর দ্বিতীয়বার হামলা চালিয়ে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে আদর্শিক ভিত্তি করে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যুদ্ধদিনে মুক্তিসেনাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। সেদিন সমবেত লাখো মানুষকে সামনে রেখে তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১৫ আগস্ট উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছে জাসদের দুই অংশ। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জাসদের বিবৃতিতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করা যায় না। তেমনি শেখ হাসিনাকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেও খাটো করা যাবে না। সংগঠনের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান এ বিবৃতি দিয়েছেন। আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় দলীয় কার্যালয়ে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা।
এদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রতিষ্ঠাতা। ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাঙালির হৃদয়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসন থেকে বঙ্গবন্ধুকে ম্লান করা যাবে না।
গত ১২ মে অন্তর্বর্তী সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তার আগে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছাত্রলীগকে। ফলে ১৫ আগস্ট ঘিরে দলটি কোনো কর্মসূচি পালনের সুযোগ পাচ্ছে না। তবে যার যার অবস্থান থেকে ব্যক্তিগতভাবে শোক পালন করছেন অনেকে।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিরাপত্তা জোরদার : ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেখানে পুলিশের এপিসি ও রায়টকার মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি সদস্য নিয়োজিত করা হয়। এদিন সন্ধ্যার পর থেকে ৩২ নম্বরে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের মিছিল করতে দেখা গেছে। দলের স্থানীয় বিভিন্ন নেতার নাম উল্লেখ করে দফায় দফায় মিছিল করেন কিছু নেতাকর্মী। তারা শেখ হাসিনার ফাঁসি দাবি করেন। আজ শুক্রবার সারাদিন সেখানে থাকবেন বলে জানান তারা। এ সময় অপরিচিত অনেকের মোবাইল ফোন সেট তল্লাশি করতে দেখা গেছে। সেখানে ‘সন্দেহজনক’ ঘোরাঘুরির অভিযোগে তিনজনকে আটক করা হয়। ধানমন্ডি থানার ওসি ক্যশৈন্যু মারমা বলেন, আটক তিনজনের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সন্দেহে ছাত্রশিবিরের ঢাকা কলেজ ইউনিটের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মো. মামুনকে মারধরের ঘটনা ঘটে। আহত শিবির নেতার অভিযোগ, তিনি এখানে আসার পর কিছু লোক তাকে মারধর করে। কাছেই পুলিশ ছিল। তিনি অনেক ডেকেও পুলিশের কোনো সাড়া পাননি। এ সময় আহাদ নামে ঢাকা কলেজ ছাত্রশিবিরের এক সদস্যকেও মারধরকারীরা ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে যায়। রাত ৯টার দিকে আওয়ামী লীগ কর্মী সন্দেহে আরেকজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে।
রাত ১১টার দিকে শুক্রাবাদ মোড়ে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, চলন্ত একটি গাড়ি থেকে ককটেল ছোড়া হয়েছে। তবে কেউ হতাহত হয়নি।
পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ৩২ নম্বরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সড়কটি ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। এটা হয়তো দুএক দিন থাকবে। কিছু দিন ধরেই নানা ষড়যন্ত্র চলছে। পুলিশ বলছে, ১৫ আগস্ট উপলক্ষে নিষিদ্ধ সংগঠনের কেউ সমবেত হতে পারবে না। পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
সারাদেশে গ্রেপ্তার : ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে এক হাজার ৮৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগের দিন গ্রেপ্তার হন এক হাজার ৮৫৮ জন। এ ছাড়া রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৩ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এদিকে পুলিশ সদরদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মামলা ও ওয়ারেন্টভুক্ত রয়েছেন এক হাজার ২২০ জন। অভিযানে একটি তলোয়ার, একটি লোহার পাইপ, একটি তালা কাটার, একটি লোহার চাবুক, একটি কোঁচ, দুটি তীর, একটি একনলা বন্দুক, ১৩ রাউন্ড কার্তুজ, একটি দেশে তৈরি এলজি, এক রাউন্ড ১২ বোর কার্তুজ (সিসা) উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে ঢাকা মহানগর এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত ১১টা থেকে আজ রাত ১২টা পর্যন্ত যে কোনো ধরনের ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ করেছে ডিএমপি। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সই করা এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
গোপালগঞ্জে অতিরিক্ত পুলিশ : গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ১৫ আগস্ট ঘিরে গোপালগঞ্জে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আশপাশের জেলা থেকে পুলিশ সদস্যদের গোপালগঞ্জে আনা হয়েছে। সেনাবাহিনী, র্যাব ও এপিবিএন সদস্যদের পাশাপশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত।
গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. সারোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, ১৫ আগস্ট সামনে রেখে গোপালগঞ্জে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যতটুকু ঝুঁকি আছে, সেটি মোকাবেলা করার মতো পর্যাপ্ত পুলিশ রয়েছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com