পদত্যাগের আলোচনা
সব দৃষ্টি ঠেকেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দিকে
প্রকাশ : ২৪-০৫-২০২৫ ১১:৪১

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে চাইছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে বৃহস্পতিবার (২২ মে) রাত থেকে। ক্ষোভ ও হতাশা থেকেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছেন বলে জানা যায়। এ খবর সারাদেশে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এ নিয়ে বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অধ্যাপক ইউনূস পদত্যাগ করুন, কোনো দলই সেটি চায় না। তবে দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় চায়।
প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনায় তার পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেন। জানা যায়, এ সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। প্রায়ই সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতাসহ দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
এর আগে, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’-এ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ও একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বক্তব্য দেন। এর পরপরই অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের খবর সামনে আসে; যা রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌশলগত সংকেত হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন কেউ কেউ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, তারা ইউনূসের পদত্যাগ চান না, বরং একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনের রোডম্যাপ চান। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ব্যাংকক থেকে বলেন, আমরা স্থিতিশীলতা ও একটি অবাধ নির্বাচন চাই। এ জন্য নির্বাচনের রোডম্যাপ চাওয়া কি অপরাধ?
ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করীমসহ কয়েকটি ইসলামপন্থী দলের নেতারা অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেন, তার পদত্যাগ দেশে সংকট তৈরি করবে। খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক বলেন, তিনি চলে গেলে রাষ্ট্র অনিশ্চয়তায় পড়বে। রোডম্যাপ দিন, পদত্যাগ নয়।
এনসিপি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল একত্রিত হয়ে অধ্যাপক ইউনূসকে দায়িত্বে রাখতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। বেশ কয়েকটি দল অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাকে অনুরোধ করেছেন যাতে তিনি দায়িত্বে বহাল থাকেন এবং একটি সুস্পষ্ট নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। সরকার সংশ্লিষ্ট অনেকেই তাকে পদত্যাগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। এনসিপির মতে, ইউনূস পদত্যাগ করলে দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হবে। তারা মনে করেন, তার নেতৃত্বেই রাষ্ট্র সংস্কার এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব।
এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের চারজন নেতা জানান, অধ্যাপক ইউনূস বেশ কিছু কারণে বিরক্ত। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব ও সেনাপ্রধানের বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আগ বাড়িয়ে কথা বলা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তিতে প্রতিক্রিয়া, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবির আন্দোলন যমুনা পর্যন্ত চলে আসা এবং সম্প্রতি বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য অন্যতম।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বেই জুলাই গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হবে, সেটিই আমরা দেখতে চাই।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা মনে করি, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হওয়া অনিবার্য। তিনি যদি পদত্যাগ করেন, তাতে যে শূন্যতা তৈরি হবে, সেটি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা একেবারেই অনিশ্চিত। তাই এ ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হোক, কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাম্য হতে পারে না।
বিএনপি সূত্র থেকে জানা যায়, বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চেয়ে গত মঙ্গলবার তার কার্যালয়ে বার্তা পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত কোনো সাড়া না পেয়ে বিএনপি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ তিন উপদেষ্টার অব্যাহতি চায়। এরপর রাতে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনা-সংক্রান্ত খবর ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে।
প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে চান, এ খবর জানাজানির পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চাওয়া হয়। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, বিএনপিকে আজ শনিবার (২৪ মে) সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সাক্ষাতের সময় দেওয়া হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বৃহস্পতিবার রাতেই এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান জানান। জামায়াত নেতা শুক্রবার (২৩ মে) বেলা ১১টায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যান। তবে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ পাননি; আজ সন্ধ্যা ছয়টায় জামায়াতের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পদত্যাগের আলোচনার পর ড. ইউনূস শুক্রবার সারাদিন সরকারি বাসভবন যমুনায় ছিলেন।
আজ শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা হওয়ার কথা রয়েছে। এ সভায় সাধারণত উপদেষ্টারা যোগ দেন। নিয়মিত সভার পর প্রধান উপদেষ্টা চাইলে উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করতে পারেন। তবে আজকের একনেক বৈঠকের পর কোনো সংবাদ ব্রিফিং হবে না বলে আগেই জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বলেন, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টারা উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে বিশেষ আলোচ্যসূচি রয়েছে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। সমসাময়িক ইস্যুতে উপদেষ্টা পরিষদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে কোনো নির্দেশনা দেয়নি।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, একনেক বৈঠকে উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি চলমান ইস্যু নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ বৈঠকে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সব কর্মকর্তাই উপস্থিত থাকেন। অতীতে একনেক বৈঠকেও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হওয়ার নজির আছে।
একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার কোনো উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেননি অধ্যাপক ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।
পদত্যাগ বিষয়ে শুক্রবার সরকারের দিক থেকে একমাত্র মতামত জানিয়েছিলেন ড. ইউনূসের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না। অধ্যাপক ইউনূসের ক্ষমতা প্রয়োজন নেই, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরে ড. ইউনূসকে দরকার আছে।’ অবশ্য কয়েক ঘণ্টা পর ফয়েজ আহমদ জানান, এ লেখা তার ব্যক্তিগত অভিমত, সরকারি ভাষ্য নয়।
এদিকে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এক অনুষ্ঠান শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একটি সময় দিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তার এক দিনও এদিক-সেদিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের তিনটি কঠিন দায়িত্ব রয়েছে– সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। শুধু নির্বাচন করার জন্যই অন্তর্বর্তী সরকার আসেনি।
সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, দায়িত্ব পালন তখনই সম্ভব হবে, যখন সবার সহযোগিতা থাকবে। দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। তাই সরকার দায়িত্ব পালন করতে পারবে কিনা, চিন্তা করছে। না পারলে কী করণীয়, তাও চিন্তা করেছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com