সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে সরকার
প্রকাশ : ২৫-০৫-২০২৫ ১১:৩৮

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক পরিবর্তনের পরিকল্পনা নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কর্মসূচিগুলো নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। এতে উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ বাড়ানো হলেও, বিদ্যমান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কর্মসূচি বাতিলের সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে যেখানে ১৪০টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু রয়েছে, নতুন কাঠামোতে তা কমিয়ে ১০০টির নিচে নামিয়ে আনার প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি কর্মসূচিকে ‘দরিদ্রবান্ধব’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে; যা ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, এসব ৩৮টি কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হবে অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি বাজেটে এবার প্রতিটি কর্মসূচির জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এতদিন ধরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বাজেট ঘোষণা করা হতো, তার একটি বড় অংশ আসত উন্নয়ন খাতের অন্যান্য কর্মসূচি থেকে। এবার সরকার সে ধরনের কর্মসূচি বাদ দিয়ে কেবল প্রকৃত সামাজিক নিরাপত্তার চিত্র তুলে ধরতে চায়।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রায় ৯৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে; যা মোট বাজেটের প্রায় ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৯০ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা; যা ছিল মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তবে বর্তমানে চালু ১৪০টি কর্মসূচি বহাল রাখলে এ বরাদ্দ বাড়ে দাঁড়াতো প্রায় এক লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকায়।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংস্কার বহুদিনের দাবি। সরকার যে উদ্যোগ নিচ্ছে, তা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে কোন কোন কর্মসূচি বাদ পড়বে, সে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। কর্মসূচিগুলো দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য চালু হলেও বাজেট বরাদ্দ এখনো যথেষ্ট নয়। জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশ এই খাতে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় করে। নতুন বাজেটে এ চিত্র বদলানো জরুরি।
আসন্ন বাজেটে কয়েকটি মূল নগদ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি মাসিক ভাতা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সেলিম রায়হান মনে করেন, প্রতি বছরই ভাতা সামান্য পরিমাণে বাড়ানো হয়; যা বাস্তব প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এই বাড়তি টাকা দিয়ে উপকারভোগীরা খুব একটা উপকার পান না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়ের হার এখনো কম। অপরদিকে সুদ, ভর্তুকি এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভাতা বাড়ানোর পরিমাণ সীমিত রাখা হয়েছে। চরম দরিদ্রদের জন্য নির্ধারিত ৩৮টি ‘দরিদ্রবান্ধব’ কর্মসূচিতে আগামী বাজেটে বরাদ্দ হতে পারে প্রায় ৫২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা।
বয়সজনিত ভাতা কর্মসূচি; যা ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে চালু হয়েছিল, সেটি এখন দেশের সবচেয়ে বড় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। নতুন বাজেটে মাসিক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই কর্মসূচিতে এক লাখ নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবেন, ফলে উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬১ লাখে। চলতি অর্থবছরে এই কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল চার হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসূচি হচ্ছে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দুস্থ নারী ভাতা। ১৯৯৮ সালে চালু হওয়া এই কর্মসূচিতে ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হচ্ছে এবং নতুন এক লাখ ২৫ হাজার নারী এতে যুক্ত হবেন। বর্তমানে উপকারভোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৭৫ হাজার এবং চলতি বাজেট ছিল এক হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।
শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ভাতা কর্মসূচিতে মাসিক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুই লাখ নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবেন। বর্তমানে উপকারভোগীর সংখ্যা ৩২ লাখ ৩৪ হাজার, বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ৩২১ কোটি টাকা। বেদে, হিজড়া ও অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হতে পারে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিতে ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করা হচ্ছে। উপকারভোগীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৭ লাখ ৭১ হাজার করা হতে পারে।
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ৫৫ লাখ পরিবারকে স্বল্পমূল্যে চাল সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে প্রায় ১০ লাখ টন চাল বিতরণ করা হবে, যা গত বছরের তুলনায় দুই লাখ ৪০ হাজার টন বেশি। এবার পরিবারগুলো পাঁচ মাসের পরিবর্তে ছয় মাস ৩০ কেজি করে চাল পাবে। চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে দৈনিক মজুরি ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০ টাকা করা হতে পারে। উপকারভোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ১৮ হাজার থেকে বেড়ে ছয় লাখে উন্নীত হতে পারে।
সেলিম রায়হান বলেন, উপকারভোগীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কেবল সংখ্যা নয়, বরাদ্দের পরিমাণও গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন সত্যিকারের পরিবর্তনের, যাতে প্রান্তিক মানুষ বাস্তব উপকার পায়। আমাদের দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এবার বাজেটে যদি অন্তত কিছু সুপারিশ প্রতিফলিত হয়, তাহলে বলা যাবে আমরা উন্নয়নের সঠিক পথে এগুচ্ছি।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com