খেলাপি ঋণের ৭১ শতাংশ ১০ ব্যাংকে, ব্যাংকিং খাতে চাপ বাড়ছে
প্রকাশ : ১৯-০৬-২০২৫ ১১:২৮

ছবি : সংগৃহীত
পিপলসনিউজ ডেস্ক
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৭১ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলে মাত্র ১০টি ব্যাংকের ঘাড়ে। এই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে; যার ফলে গোটা ব্যাংকিং খাতের ওপরই চাপ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাস শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ১০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণই তিন লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা; যা মোট খেলাপি ঋণের ৭১ শতাংশেরও বেশি।
এই ১০ ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি হলো— অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংক। বেসরকারি ছয়টি ব্যাংক হলো— ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের। মার্চ পর্যন্ত এই ব্যাংক মোট ৯৪ হাজার ৭৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে; যার মধ্যে ৭০ হাজার ৮৪৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। এক সময়ের জনপ্রিয় এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ধারাবাহিক আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে— যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো অ্যানটেক্স, ক্রিসেন্ট, বেক্সিমকো, থার্মেক্স ও এস আলম গ্রুপ। মাত্র নয় মাসেই ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৮ শতাংশ—২০২৩ সালের জুনে যা ছিল ৪৮ হাজার কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের খেলাপি ঋণও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। দেশের বৃহত্তম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকার সময় বিপুল ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ঋণের মধ্যে একাই এস আলম গ্রুপ ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে অর্ধেকেরও বেশি। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র সাত হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। অথচ চলতি বছরের মার্চে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা; যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা; যা এর বিতরণকৃত ঋণের ৪১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এই পরিমাণ গত বছরের জুনের তুলনায় ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে অগ্রণী ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন, যার বড় একটি অংশ অনাদায়ী রয়ে গেছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের অবস্থাও ভগ্নপ্রায়। মার্চে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা; যা তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬৪ শতাংশ। নয় মাস আগে এটি ছিল ২০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে। ন্যাশনাল ব্যাংকও সেই তালিকায় ছিল। দেশের প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋণ অনিয়ম, দুর্বল প্রশাসন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিপুল লোকসানে পড়ে। ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকটির ওপর সিকদার গ্রুপের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
এস আলম গ্রুপের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা আরও তিনটি ব্যাংক— ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণও উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটির খেলাপি ঋণ মার্চে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা; যা তাদের বিতরণকৃত মোট ঋণের ৩৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বা ৩৮ শতাংশ এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা; যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ।
আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণও গত এক বছরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ২০২৩ সালের জুনে যেখানে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল তিন হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৯৭১ কোটি টাকায়। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সাবেক চেয়ারম্যান এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এই ব্যাংককে দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মার্চে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা; যা তাদের মোট ঋণের ২১ দশমিক ১১ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা; যা ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৬ শতাংশ।
ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক খান জানান, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে বড় ঋণগ্রহীতাদের অসহযোগিতার কারণে তেমন সাফল্য আসছে না। তিনি আরো জানান, এস আলম গ্রুপসহ একাধিক বড় ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে ২৪টি এবং নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনে ৩৭০টি মামলা করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, আমানতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিগত সরকারের আমলের অনিয়মই দায়ী। তিনি চান, প্রকৃত অবস্থা যেন সবার সামনে আসে, তাই প্রকৃত খেলাপি হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, ঋণ আদায়ে ব্যাংকটির প্রচেষ্টা সন্তোষজনক নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে আইন প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল। তাঁর মতে, যদি খেলাপিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন না করা হয়, তাহলে অন্যরাও উৎসাহিত হবে ঋণ খেলাপিতে। এভাবে চলতে থাকলে গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা আরও বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com