স্বর্ণের দাম আকাশছোঁয়া, বদলে যাচ্ছে সামাজিক উপহারের সংস্কৃতি
প্রকাশ : ১৮-১০-২০২৫ ১২:১৫

ছবি : সংগৃহীত
পিপলসনিউজ ডেস্ক
বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ কেনার প্রবণতা বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারেও। ফলে দেশের স্বর্ণ ক্রেতারা চরম চাপে পড়েছেন, তবু কেউ কেউ ভবিষ্যতে আরো দাম বাড়ার আশায় এই মূল্যবান ধাতুতে বিনিয়োগ করছেন।
ঢাকার মিরপুরের বেসরকারি চাকরিজীবী ফারজানা খালিদ সম্প্রতি তার ভাবীর বিয়ের উপহার হিসেবে একটি স্বর্ণের কানের দুল কিনেছেন। দাম পড়েছে ৫০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, দুই বছর আগেও একটি ছোট লকেটসহ চেইন অর্ধেক দামে পাওয়া যেত। এখন সেই একই জিনিসের দাম প্রায় দ্বিগুণ। আগে যে টাকায় বড় গহনা কেনা যেত, এখন সেটায় ছোট্ট কিছুই মেলে না।
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৩ বছর আগে আমার বিয়েতে আত্মীয়রা অনেক ছোট ছোট গহনা উপহার দিয়েছিলেন। এখনকার দামে তেমন উপহার দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে স্বর্ণ শুধু সম্পদের প্রতীক নয়, বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে এটি অপরিহার্য উপহার হিসেবেও বিবেচিত। কিন্তু এখন এক ভরি স্বর্ণের দাম দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকায়— যা ২৬ মাস আগের তুলনায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) জানিয়েছে, এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে ক্রেতা সংখ্যা অন্তত ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারের প্রধান ক্রেতা মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপে অতিষ্ঠ। ফলে বিয়ে, উৎসব কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্বর্ণ কেনা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
বরিশালের শাহাদাত জুয়েলার্সের মালিক শেখ মোহাম্মদ মুসা বলেন, আমাদের দৈনিক বিক্রি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। আগে বিয়ে বা পূজার সময় ভালো ব্যবসা হতো, এখন ক্রেতা হাতে গোনা।
খুলনার এক ব্যবসায়ী জানান, তার দোকানে বিক্রি কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। তিনি বলেন, অনেকে এখন শুধু জরুরি প্রয়োজনে স্বর্ণ কিনছেন। দুর্গাপূজার সময় বহু বিয়ে হলেও নতুন গহনা কেনা হয়েছে খুবই সীমিত পরিসরে। কেউ কেউ পুরনো গহনা গলিয়ে নতুন ডিজাইন করছেন, কেউ শুধু ছোট আংটি বা পাতলা চেইন নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট দশমিক ৩৬ শতাংশে, যা আগস্টে ছিল আট দশমিক ২৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে সাত দশমিক ৬৪ শতাংশ, আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি আট দশমিক ৯৮ শতাংশ।
বাজুসের সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বলেন, যারা আগে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকার ছোট গহনা কিনতেন, তারা এখন পুরোপুরি কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য এখন স্বর্ণ কেনা প্রায় বিলাসিতা।
এদিকে, শ্রীমঙ্গলের একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সুকান্ত দাস জানান, তিনি ২০২৬ সালে বিয়ে করবেন বলে এখন থেকেই স্বর্ণ কেনার জন্য সঞ্চয় করছেন। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে বিয়েতে স্বর্ণ না থাকলে সেটা অসম্পূর্ণ মনে করা হয়। তাই অন্য খরচ কমিয়ে হলেও কিছু স্বর্ণ কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এখন নতুন স্বর্ণের বদলে পুরোনো গহনা বিক্রি বা বিনিময়ের প্রবণতা বেড়েছে।
বরিশালের গৃহিণী কবিতা ঘোষ বলেন, আগে দুর্গাপূজায় আমরা ছোটখাটো স্বর্ণের উপহার দিতাম। এখন সেটা কেউ দেয় না—দাম এত বেড়ে গেছে যে সাধ্যের বাইরে।
বাজুসের তথ্যমতে, স্থানীয় চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও স্বর্ণের দাম বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বর্তমানে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম চার হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। রয়টার্স জানিয়েছে, ২০২৫ সালে স্বর্ণের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা উল্লেখ করছেন রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি, ইউরোপের ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মার্কিন মুদ্রানীতির অনিশ্চয়তা।
ফরাসি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান সোসিয়েতে জেনেরাল জানিয়েছে, বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বাড়তি চাহিদার কারণে প্রতি ট্রয় আউন্স স্বর্ণের দাম পাঁচ হাজার ডলারে পৌঁছানো এখন প্রায় সময়ের ব্যাপার।
স্বর্ণ ও ডলারের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বিপরীত। ডলারের মান কমলে স্বর্ণের দাম সাধারণত বাড়ে। বর্তমানে ডলারের মান ২০১৭ সালের পর সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায়, আর স্বর্ণের দাম ১৯৭০-এর দশকের পর সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনতে ডলারের পরিবর্তে স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছর তারা এক হাজার টনেরও বেশি স্বর্ণ কিনছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র বাদে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে এখন ২৯ হাজার ৯৯৮ দশমিক ৪০ টন স্বর্ণ রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় তিন দশমিক ৯৩ ট্রিলিয়ন ডলার— এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকা বিদেশি ট্রেজারি বন্ডের মোট মূল্যেরও চেয়ে বেশি।
এক দশক আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে স্বর্ণের অংশ ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, যা এখন বেড়ে ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ঋণ-সংকটের আশঙ্কায় ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরাও নিরাপদ বিকল্প হিসেবে স্বর্ণে ঝুঁকছেন। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে স্বর্ণভিত্তিক এক্সচেঞ্জ–ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) রেকর্ড ২৬ বিলিয়ন ডলার নতুন বিনিয়োগ এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে বর্তমানে স্বর্ণের পরিমাণ ১৪ দশমিক ২৮ টন। তুলনায় পাকিস্তানের রিজার্ভে আছে ৬৪ দশমিক ৭৫ টন, আর ভারতের কাছে রয়েছে ৮৭৯ দশমিক ৯৮ টন স্বর্ণ।
বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজারে বৈশ্বিক প্রভাবের পাশাপাশি দেশীয় সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা থাকলেও শিল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এর ৮০ শতাংশই পাচারের মাধ্যমে আসে। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারায় এবং বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ২১টি অনুমোদিত আমদানিকারক মিলে মাত্র এক টনেরও কম স্বর্ণ আনতে পেরেছে। ফলে ব্যাগেজ নীতির আওতায় বিদেশ ফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে আনা স্বর্ণই হয়ে উঠেছে বাজারের প্রধান সরবরাহ উৎস।
কোভিড-১৯-এর পর থেকে টাকার মান ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এক ভরি স্বর্ণের দাম প্রথম ৫০ হাজার টাকা ছাড়ায়। ২০২৩ সালে তা দাঁড়ায় এক লাখ, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক লাখ ৫০ হাজার, আর বর্তমানে তা দুই লাখ ১৬ হাজার টাকার ওপরে। শুধু ২০২৫ সালেই স্বর্ণের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ।
বাজুস মনে করে, বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে স্বর্ণের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।
স্থানীয় স্টার্টআপ ‘গোল্ড কিনেন’-এর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আতেফ হাসান বলেন, স্বর্ণের দামের এই উল্লম্ফন আসলে বিশ্ববাজারের বড় পরিবর্তনের প্রতিফলন। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে স্বর্ণই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পদ।
তার মতে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম প্রায় ৫৬ শতাংশ বেড়েছে, যা প্রমাণ করে মানুষ এখন এটিকে অলংকার নয়, বিনিয়োগ হিসেবেও গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন, গ্রাহকদের মধ্যে এখন স্বর্ণের বার ও কয়েন কেনার আগ্রহ বাড়ছে। বিশেষ করে আমাদের চালু করা শূন্য দশমিক পাঁচ গ্রামের স্বর্ণের বারটি খুব জনপ্রিয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু ক্রেতা এখনো ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়বে— এই আশায় গহনা কিনছেন। তবে সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, স্বর্ণের দামের ঊর্ধ্বগতি শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের মানই বাড়াচ্ছে না, বরং ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবারে উপহার দেওয়ার সংস্কৃতিকেও নতুন করে গড়ে দিচ্ছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com